বঙ্গবার্তা ব্যুরো,
হাওড়ার সালকিয়ার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে শীতলা মায়ের জনপ্রিয়তা সমধিক। পল্লী বাংলার পালপার্বণের মধ্যে শীতলার নাম সামান্য উল্লেখ থাকলেও সালকিয়ার এই পুজোর কোন উল্লেখ কোন গ্রন্থে চোখে পড়েনি এর কারণ অজানা।প্রকৃতপক্ষে শীতলা মায়ের স্নানযাত্রা উৎসব এখানকার এক অনন্য উৎসব।মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বসন্ত রোগের দেবী শীতলা মায়ের স্নানযাত্রা সমগ্র উত্তর হাওড়ার এক বিশেষ আঞ্চলিক উৎসব।
এই উৎসবে যেমন জাতির গণ্ডি নেই তেমনি ধর্মেরও কোন বাধা নিষেধ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ, চীনা এমন কি মুসলমানেরাও এই দেবীর কৃপালাভের জন্য মিলিত হয়। মাঘী পূর্ণিমার দিনে উত্তর হাওড়ার সমস্ত রাস্তাঘাটে বেলা থেকে রাত ১২টা অবধি যানবাহন চলাচল বন্ধই হয়ে যায়, শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা ব্যতীত।
শোনা যায়, বহুপূর্বে একজন কর্তব্যরত পুলিশ বাঁধাঘাটে মাঘ মাসে পুর্ণিমার গভীর রাতে সাতজন মহিলাকে গঙ্গায় স্নান ক’রতে দেখে। এই দৃশ্যের কথা সে অন্য সকলকে বলায় সে মারা যায়। তারপর থেকেই নাকি এই অঞ্চলে শীতলা মায়ের স্নানযাত্রার প্রচলন। শীতলা গুটিদানা জনিত হাম, বসন্ত ইত্যাদি রোগের দেবী। বসন্ত ঋতুতে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভক্তদের বিশ্বাস এই সময়ে দেবী নিজে গঙ্গায় স্নান করে যেমন নিজ দেহ শীতল করেন তেমনি এ দেশের মাটিকেও শীতল করেন। শীতলাদেবী আবার পরিচ্ছন্নতার দেবী। তাই দেখতে পাওয়া যায় যে, অপরিচ্ছন্ন বাড়িতেও ঐ রোগ হালে প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হ’য়েই তাঁরা বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন করে রাখে। শীতলার রূপ বর্ণনাতেও বলা হয়েছে
নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাং দিগম্বরীং। মার্জনীকলসোপেতাং সূর্পালস্কৃতমস্তকাম্। গর্দভ পৃষ্ঠে উলঙ্গ শীতলাদেবী হাতে ঝ্যাঁটা ও কলসী এবং মস্তকে কুলো নিয়ে অধিষ্ঠিতা। এখানে শীতলা দেবী আবক্ষা-কিন্তু অন্যত্র পূর্ণাবয়ব শীতলাদেবীই দেখতে পাওয়া যায়।
কেবলমাত্র শালিখা কয়েল বাগানের কয়েলেশ্বরী শীতলা মা হচ্ছেন পাথরের মূর্তি। হরগঞ্জ বাজারের বড়শীতলা মা ও কয়েলেশ্বরী শীতলা মা স্বয়ম্ভূ দেবী ব’লে জানা যায়। এই শীতলা দেবীরা সাতবোন।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হর গঞ্জ বাজারের বড় মা শিতলা মা শোভাযাত্রা যার হয় প্রায় দু মাইলের অধিক । এর মধ্যে উপেন্দ্রনাথ মিত্র লেন যা মুরগি ঘাটা নামে বেশি পরিচিত শীতলা মা কখনও স্নানে বের হন না,যাকে সকলে ছোট মা বলে থাকেন। সাধারণ মানুষের মুখে আজও শোনা যায় যে কোনো এক সময় মাঘী পূর্ণিমার স্নান যাত্রায় সাত বোন গঙ্গায় স্নান করতে গেলে ছোট বোন অর্থ ছোট মা হারিয়ে যান সেই থেকে ছোট মাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন । তাই অন্যান্য বোনেরা ছোট মা র সাথে দেখা করে যান সেই প্রথা আজও পালন হয়ে আসছে।
শীতলা দেবী অতি অল্পেই সন্তুষ্ট হন। সামান্য বাতাসা, এক ঘটি জল ঢেলে রাস্তা ও মন্দির পরিষ্কার ক’রে পুজো দিলেই তিনি ভক্তের ওপর প্রীত থাকেন। ধর্ম বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দিলেও এই স্নানযাত্রা উৎসব যে বিভিন্ন ধর্মের ও জাতের এক মিলনতীর্থে পরিণত হয় যাতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও প্রাদেশিকতার দুষ্ট ক্ষত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে এক নবভারত মুক্তি ও গঠনের কাজে তা সহায়ক হ’য়ে উঠে।