ইজরায়েলের সামনে ত্রিমুখী সংকট, আগুনে ঘি ঢালছেন নেতানিয়াহু মন্তব্য দ্যা ইকোনমিস্ট

Published By Subrata Halder, 28 May 2025, 04:54 p.m.

বঙ্গবার্তা ব্যুরো,
ইজরায়েল ও তার প্রতিষ্ঠানগুলির উপর চাপ চরমে পৌঁছেছে। একটি গুরুত্বপূর্ন মুহূর্ত যে আসন্ন, তা স্পষ্ট। তবে সেই পরিণতি গাজার পুনরায় আক্রমণ হিসেবে আসবে কি না, যা ইজরায়েলের জোটকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে এবং তার সেনাবাহিনী ও সমাজকে বিভক্ত করবে নাকি যুদ্ধবিরতি বা ইউটার্নের মধ্য দিয়ে, যা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক পতন ঘটাবে তা এখনো অনিশ্চিত।
ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একসঙ্গে তিনটি সংকটে আগুন দিচ্ছেন গাজায় মানবিক বিপর্যয়, ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন হারানো এবং নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী ও আদালতকে কেন্দ্র করে একটি সাংবিধানিক সংকট।
প্রথমে গাজার কথা বলা যাক। সেখানে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ একটি ধ্বংসাত্মক অভিযানের প্রধান পর্যায় শুরু করার প্রস্তুতিতে রয়েছে। তারা এরই মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং প্রতিদিনই হামলায় প্রাণহানি ঘটছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আইডিএফ পুরো গাজার ৭৫ শতাংশ দখল করবে এবং ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাকি ২৫ শতাংশ জমিতে ঠেলে দেবে। লক্ষ্য হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করা। কিন্তু সম্ভাব্য ফলাফল হলো আরও একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
ইউরোপের সমর্থন প্রত্যাহার
এই বিমান হামলা এবং পুনরায় আক্রমণের সুস্পষ্ট ব্যর্থতার আভাস ইউরোপে অবস্থান পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের বর্বর হামলার পর ইউরোপ মোটামুটি ইজরায়েলকে সমর্থন করে এসেছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাজ্য নতুন বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৭টি সদস্য, যারা ইসরায়েলের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনার দাবি তুলেছে।
গত ২৭ মে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বেসামরিক মৃত্যুকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেন। তার আগের দিন জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ বলেন, ‘গাজায় বর্তমান হামলার মাত্রা আর ন্যায্যতা পাচ্ছে না।’
এ অবস্থায় জার্মানি হয়তো সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি সীমিত করতে পারে অথবা তাদের ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইজরায়েলের অস্ত্র আমদানির ৩৩ শতাংশই গেছে জার্মানি থেকে।
ইজরায়েলকে নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। গত ২৫ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি ‘এই পুরো পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব থামাতে চান।’
আগুনে ঘি ঢালছেন নেতানিয়াহু
যখন গাজাবাসী অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে এবং মিত্ররা পিছু হটছে, তখন নেতানিয়াহু আরও একটি সংকটে ঘি ঢালছেন নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং আদালতকে ঘিরে একটি সাংবিধানিক টানাপোড়েন।
তিনি শিন বেত নিরাপত্তা সংস্থা এর প্রধান হিসেবে একজন মেসিয়ানিক ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী জেনারেলকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নেতানিয়াহু হামাসের হামলায় অপ্রস্তুত থাকার দায় ওই সংস্থার ওপর চাপাতে চান।
বিদায়ী প্রধান রোনেন বার অভিযোগ করেছেন, নেতানিয়াহু নিজে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন, সংস্থাকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন এবং নিজের অফিসে দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে তাকে বরখাস্ত করছেন।
সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াইয়ের পর, যেটি রোনেন বার-এর পক্ষে যায়, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে ১৫ জুন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।
তার স্থলাভিষিক্ত হবেন মেজর জেনারেল ডেভিড জিনি। আইডিএফ-এর একটি বৈঠকে তিনি বন্দি বিনিময়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার মতে, ‘এটি চিরন্তন যুদ্ধ।
শিন বেত-এর প্রধান হিসেবে তিনি নির্ধারণ করবেন, কোন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হবে। অথচ তার অবস্থান বেশিরভাগ ইসরায়েলির মতের বিপরীত যারা এখন যুদ্ধবিরতি ও অবশিষ্ট প্রায় ২০ জন জীবিত জিম্মির মুক্তি চায়।
অ্যাটর্নি জেনারেল গালি বাহারাভ মিয়ারা প্রধানমন্ত্রীকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, রোনেন বারকে বরখাস্ত করার আগে আইনগত নির্দেশ না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু নেতানিয়াহু তা উপেক্ষা করেছেন।
এই ঘটনায় ইজরায়েলের নিরাপত্তা প্রধানদের মধ্যে গভীর মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আইডিএফ এর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামিরকে জেনারেল জিনির নিয়োগ সম্পর্কে কিছুই জানাননি।
গত ২৫ মে জেনারেল জামির স্পষ্ট বার্তায় বলেন, এটি অন্তহীন যুদ্ধ নয়। তার মতে, হামাসকে টার্গেট করার চেয়ে জীবিত জিম্মিদের রক্ষা ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।
নেতানিয়াহু এই দ্বন্দ্বকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করতে চাইছেন। এমনকি যদি আইনি জটিলতায় পড়ে শিন বেত প্রধানের নিয়োগ থেকে তাকে সরেও আসতে হয়, তবুও তিনি এই সংঘাতকে ব্যবহার করে রণক্লান্ত ইসরায়েলিদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে এবং কট্টরপন্থি সমর্থকদের উদ্দীপ্ত করতে চাইছেন।
নেতানিয়াহু জানেন, গাজায় যুদ্ধ সম্প্রসারণের তার জনপ্রিয়তাহীন পদক্ষেপ হয়তো কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। বরং ইউরোপ এবং সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। কিন্তু বিকল্প, অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি মানে হবে তার কট্টর ডানপন্থিদের সমর্থন হারানো, যারা গাজার স্থায়ী দখল দাবি করে এবং শেষ পর্যন্ত নতুন নির্বাচন ডেকে আনা।
এই রাজনৈতিক ফাঁদে আটকা নেতানিয়াহুর কৌশল এখন আরও সংকট উসকে দেওয়া। তার ধারণা, তিনি এসব দ্বন্দ্ব থেকে বিজয়ী হয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি এমন এক আগুন জ্বালাচ্ছেন যার ভস্মে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই ছারখার হয়ে যেতে পারে।

08:14