প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান ৬ ফেব্রুয়ারি
চিটফান্ড খুলে কোটি কোটি টাকা প্রতারণার ঘটনা
একদা তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল বঙ্গে।এবার
একই রকম প্রতারণার অভিযোগে কাঠগড়ায় খোদ
ভারতীয় ডাক বিভাগ।কঠিন কায়িক পরিশ্রম করে
রোজগার করা ১২ লক্ষাধীক টাকা পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে গচ্ছিত রেখে এখন সর্বসান্ত এক কুমোর পরিবার।সঞ্চয়ের অর্থ ফিরে পেতে তাঁরা পুলিশ,জেলা ও রাজ্যের প্রধান ডাক বিভাগ সহ সিবিআই দফতরেও অভিযোগ জানিয়ে ছিলেন।কিন্তু সুরাহা কিছ না হওয়ায় প্রতারিত পাল পরিবারের সদস্যরা কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।হাই কোর্ট কি ন্যায় বিচার দেয় সে দিকেই এখন তাঁরা তাকিয়ে রয়েছেন।
কলকাতা হাইকোর্টে মামলাকারী পাল পরিবারের
সদস্যরা জামালপুর হাটতলা এলাকার বাসিন্দা।
নিম্নবিত্ত পরিবার ।ষাটোর্ধ্ব পরিবার কর্তা রণজিত পাল এখনও পারিবারিক পেশাকেই আঁকড়ে রয়ে আছেন। মাটির কলসি ,হাঁড়ি সহ নানা সরঞ্জাম তৈরি করে তিনি জামালপুর হাটে বসে বিক্রী করেন
।তাঁর স্ত্রী রাধারাণী পাল কঠিন রোগে আক্রান্ত।দীর্ঘদিন ধরে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রণজিত পালের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে মধুমিতা সবার বড়।তাঁর বিয়ে হয়েছে জামালপুর থানার অন্তর্গত চৌবেড়িয়া গ্রাম নিবাসী ব্যবসাদার যুবক
উৎপল পালের সঙ্গে।বড় ছেলে অভিজিৎ করেন
ইলেকট্রিকের কাজ।আর ছোট ছেলে সুরজিৎ জামালপুর বাজারে বসে ফল বিক্রী করেন ।
সুরজিৎ পাল জানিয়েছেন ,”তাঁদের পরিবারের সকলেই কঠিন কায়িক পরিশ্রম করেন।পরিশ্রম করে রোজগার করা অর্থ থেকে কিছু কিছু অংশ তাঁরা জমিয়ে রাখতেন।জমানো অর্থ জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে গচ্ছিত রাখার বিষয়ে তাঁরা মনস্থির করেন।সেইমত তিনি ছাড়াও তাঁর বাবা ও মা এবং দিদি ও জামাইবাবু জামালপুর পোস্ট অফিসে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্ট খোলেন।২০২১ সালে ১ বছরের ’ফিক্সড ডিপোজিট’ স্কিমে তাঁরা নিজের নিজের অর্থ অ্যাকাউন্টে জমা করেন
। তাঁদের সবার মিলিয়ে জমা করা টাকার পরিমাণ হচ্ছে ১২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। তদানিন্তন জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর ওই টাকা গ্রহণ করে নিয়ে শীল স্ট্যাম্প দিয়ে তাঁদের সবার অ্যাকাউন্ট বই ইস্যু করে দেন“।
ভারত সরকারের অধীন জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে সঞ্চয়ের টাকা ফিক্সিড ডিপোজিট করে নিশ্চিন্তেই ছিলেন পাল পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ ১বছর উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন রণজিত পালের স্ত্রী রাধারাণী দেবী।চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতা সহ ভিন রাজ্যের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।তখন টাকার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়লে পাল পরিবারের সদস্যরা অগ্রিম ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে টাকা তুলে নেওয়ায় জন্য জামালপুর সাব পোস্ট অফিসে যান
।রাধারাণী দেবীর ছোট ছেলে সুরজিৎ পাল বলেন
,“টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করার সময় জামালপুর সাব পোস্ট অফিস থেকে দেওয়া সমস্ত নথি নিয়ে আমরা টাকা তুলতে যাই। নথি দেখে ওই একই পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।উনি পরিস্কার জানিয়ে দেন,’আমরা নাকি কোট টাকা ফিক্সড ডিপোজিটই করি নি’। “আমার যা করতে পারিস করে নিগে যা“ বলে মন্তব্য করে পোস্ট মাস্টার আমাদের পোস্ট অফিষ থেকে এক প্রকার তাড়িয়ে দেন ।
এমন ব্যবহার পেয়ে পাল পরিবারের সদস্যরা বুঝে যান তাঁরা পোস্ট অফিসে ফিক্সড ডিপোজিট করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।সুরজিৎ জানান ,“
প্রতারণার কথা জানাতে তাঁরা জামালপুর থানায় গিয়ে ছিলেন। কিন্তু থানা তাঁদের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে।তখন কিছু আর উপায় খুঁজে না পেয়ে তাঁরা জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের তদানিন্তন পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর কে আসামী করে বর্ধমান আদালতে মামলা রুজু করেন।একই সাথে জেলা পুলিশ সুপার সহ জেলা ও রাজ্যের প্রধান ডাক বিভাগ এমনকি সিবিআই দফতরেও ঘটনা সবিস্তার লিখিত ভাবে জানান।বর্ধমান আদালত জামালপুর থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।সেই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে থানা শুধুমাত্র একটা এফআইআর রুজু করে আর তাঁদের কাছে থাকা পোস্ট অফিসের দেওয়া নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করেই দায় সারে। তাই ন্যায় বিচার পেতে গত বছরের শেষের দিকে তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন বলে সুরজিৎ পাল জানিয়েছেন।
মামলাকারী পাল পরিবারের আইনজীবী উদয় শংকর চট্টোপাধ্যায় এনিয়ে বুধবার বলেন,’পাল পরিবারের সদস্যরা কোন চিটফাণ্ডে তাঁদের সঞ্চয়ের টাকা গচ্ছিত রাখেননি।১২ লক্ষাধীক টাকা তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন পোস্ট অফিসে গচ্ছিত রেখে প্রাতারিত হয়েছেন। পোস্ট অফিস টাকা লুট করে নিয়েছে। এতবড় একটা প্রতারণার ঘটনার পরেও জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের ওই পোস্ট মাস্টারের বিরুদ্ধে ভারতীয় ডাক বিভাগ কোন ব্যবস্থা নেয় নি। জামালপুর থানাও কোন ব্যবস্থা নেয় নি।প্রতারিতরা সেই কারণেই হাইকোর্টে মামলা করেছেন।মামলায় সিআইডি তদন্তের দাবি রাখা হয়েছে।বিচারপতি
তীর্থঙ্কর ঘোষ আগামী ৭ ফেব্রুয়ারী এই মামলার সিডি কল ফর করেছেন।এতদিন কি তদন্ত হয়েছে তা বিচারপতি ওইদিন দেখবেন।’
অভিযুক্ত পোস্ট মাস্টার বিদ্যুৎ সুর এখন আর জামালপুর সাব পোস্ট অফিসের কর্মরত নেই। তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছেন।বুধবার ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই অস্বীকার করেন।তিনি পরিস্কার জানিয়ে দেন,’“সব অভিযোগ মিথ্যা“।একই সঙ্গে তিনি এও বলেন,“আমার দপ্তরের তদন্তকারীরা আমার বক্তব্য নিয়েছে।আমার যা জানানোর তা আমি আমার দপ্তরকে জানিয়ে দিয়েছি“।যদিও বিদ্যুৎ সুরের দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে জামালপুর বাসিন্দা অঞ্জন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন“শুধু পাল পরিবারই নয়। ব্লকের আরও বহু মানুষ জামালপুর পোস্ট অফিসে টাকা রেখে যে প্রতারিত হয়েছেন, তা অনেকেই জানেন।সব মিলিয়ে প্রতারনার পরিমান প্রায় দেড় -দুই কোটি টাকা হবে।এই আর্থিক প্রতারণার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে অঞ্জন বাবু মন্তব্য করেছেন“।