।। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি স্মরণে শ্রদ্ধা

অমৃত কথা

“ধর্ম যখনই বিপাকী বাহনে
ব্যর্থ অর্থে ধায়,
প্রেরিত তখন আবির্ভূত হন
পাপী পরিত্রাণ পায় ।”
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের উপরোক্ত বাণীর সাথে শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত
“যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লাণির্ভবতি ভারতঃ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনম্ সৃজাম্যহম্
পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥”
প্রায় সমার্থক বাণীটির যুগোপযোগী সংস্করণ করেছেন বর্তমান পুরুষোত্তম।
শ্রীকৃষ্ণ যুগ সংস্কারের প্রয়োজনে দুষ্কৃতি বা পাপীদের বিনাশের কথা বলেছেন আর ঠাকুর পাপীদের পরিত্রাণের কথা বলেছেন। এইটুকুই পার্থক্য।
ব্যষ্টি জীবন এবং সমষ্টি জীবনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্ম করে যাওয়ার নামই ধর্ম পালন করা। অন্যের বাঁচা এবং বৃদ্ধি পাওয়াকে অব্যাহত রেখে মানুষ বাঁচার জন্য, আনন্দের জন্য যা’ যা’ করে, তাই ধর্ম। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কোন ভারী তাত্ত্বিক কথা না বলে প্রাঞ্জল ভাষায় বাণী দিয়ে বললেনঃ
‘‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধর্ম বলে জানিস তা’কে।’’

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র চৈতন্যদেবের আবির্ভাব প্রসঙ্গে ভাবাবস্থায় বললেন, ‘‘বুদ্ধ ‘লয়’ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল। শঙ্করাচার্য্য পরিষ্কার ক’রে দিয়েছিল। বুদ্ধের উত্তর শঙ্করাচার্য্যের কাছে, জ্ঞানী ছাড়া বুঝত না কিনা? তাই চৈতন্যের আবির্ভাব। ধর্ম্ম নিয়ে হিংসা হয়েছিল কিনা, তাই একত্ব দেখাতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ। থাক্ ধর্ম্ম-কর্ম্ম, আমার আমিত্ব পেলেই বাঁচি এখন।’’ (ভাববাণী, ষষ্ঠ দিবস)

কিছু গবেষকদের মতে শ্রীচৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষ উৎকল প্রদেশের জাজপুরের আদি বাসিন্দা ছিলেন। (বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মতে আসাম প্রদেশ।) তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র বাংলাদেশের শ্রীহট্টে এসে বসতি স্থাপন করেন। শ্রীহট্টে জন্মগ্রহণ করেন জগন্নাথ মিশ্র। পণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা শচীদেবীর সাথে বিবাহ হয়। শচীদেবীর গর্ভে পর পর সাতটি কন্যা হয়। কেহই জীবিত ছিলেন না। তারপর জন্মগ্রহণ করেন প্রথম পুত্র বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের যখন আট বছর বয়স তারপর শচীমাতা অন্তর্বতী হন। দ্বাদশ মাস গর্ভকাল অতিবাহিত করে ১৪০৭ শকাব্দ, (১৮-২-১৪৮৬) ২৩ ফাল্গুন, দোলপূর্ণিমা চন্দ্রগ্রহণের রাতে নিমবৃক্ষের নীচে ভূমিষ্ঠ হন শচীদেবীর দ্বিতীয় পুত্র নদীয়া জেলার নবদ্বীপে। নিম গাছের তলায় ভূমিষ্ঠ হবার কারণে মা নামকরণ করেছিলেন নিমাই, কোষ্ঠী বিচারের নাম বিশ্বম্ভর।
চৌদ্দশত সাত শকে মাস যে ফাল্গুন
পৌর্ণ মাসী সন্ধ্যাকালে হৈল শুভক্ষণ।
সিংহ রাশি, সিংহ লগ্ন উচ্চ প্রহসন
ষড়বর্গ অষ্টবর্গ সর্ব্ব শুভক্ষণ।।


তৎকালিন ভারতবর্ষের শিক্ষা-সংস্কৃতির এক অন্যতম পীঠস্থান ছিল বাংলার নদীয়া জেলার নবদ্বীপ। মহাপ্রভুর পিতৃদেব শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন অধ্যয়ন ও শাস্ত্রচর্চার জন্য। সে কারণেই মায়াপুরে আর একটি নতুন বসতি স্থাপন করতে হয়েছিল। শচীদেবীর স্বাভাবিক গর্ভকালের সময় উত্তীর্ণ হলে শ্বশুর মশাই জ্যোতিষাচার্য পণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবর্তীর আদেশক্রমে স্ত্রী-পুত্রকে শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপের বাড়িতে নিয়ে আসেন জগন্নাথ মিশ্র। সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বম্ভর। তবে গার্হস্থ্যাশ্রমে নিমাই নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাই রচনার প্রয়োজনে অবতারবরিষ্ঠ চৈতন্য মহাপ্রভুকে কখনো নিমাই, কখনোবা নিমাই পণ্ডিত নামে উল্লেখ করতে হয়েছে। সেজন্য প্রথমেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখলাম।
শচীমাতার দুলাল নিমাই বাল্যকাল থেকেই দুরন্ত ছিলেন। তাঁর দুরন্তপনার নালিশ শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন তাঁর পিতামাতা। দাদা বিশ্বরূপকেই যা একটু সমীহ করে চলতেন। দুরন্তপনায় রাশ টানতে পিতৃদেব ১৪৯১ খ্রীষ্টাব্দে আচার্য্য গঙ্গাদাস পণ্ডিতের মাধ্যমে উপনয়ন সংস্কারে সংস্কৃত করান। সাবিত্রীমন্ত্রে দীক্ষিত করাবার পর আচার্য্য নিমাইকে গৌরহরি নামকরণ করেন। সংস্কৃত শিক্ষার জন্য গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ভর্তি করে দেন পিতা। সেখানে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তাঁর মধ্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের প্রকাশ পায়। ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে দাদা বিশ্বরূপ সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হন। দাদার বিরহ-ব্যথায় শান্ত হন নিমাই। দাদা বিশ্বরূপ নিত্য গৃহদেবতা বিষ্ণুর পূজা করতেন। দাদার অবর্তমানে নিজে থেকে সেই পূজার ভার গ্রহণ করেন নিমাই। ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দে পিতা জগন্নাথদেব সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে বিষ্ণুর পরমপদে আশ্রয় নেন। পিতার দেহান্তর হবার পর জাগতিক সংসারের সব দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়ে। নিমাই লোকপালী উপার্জনে মন দেন। মুকুন্দ-সঞ্জয়ের চণ্ডীমণ্ডপে টোল খুলে ছাত্র পড়াতে শুরু করেন। শিষ্যদের এবং বিদ্যানুরাগীদের কাছে নিমাই পণ্ডিত নামে খ্যাত হন। ভারতখ্যাত কেশবাচার্য নিমাই পণ্ডিতের কাছে পরাজয় স্বীকার করলে ভারতের পণ্ডিত সমাজে শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করেন নিমাই পণ্ডিত। মাতা শচীদেবীর আদেশে ১৫০২ খ্রীষ্টাব্দে বল্লভ আচার্যের কন্যা লক্ষীপ্রিয়া সাথে উদ্বাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। (চৈঃ চঃ অনুসারে কৈশার লীলায় প্রথমে উদ্বাহ বর্ণিত হয়েছে।) উদ্বাহের পর ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দে স্ত্রীকে নিয়ে পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের বাড়িতে যান। সেখানে সর্প দংশনে (মতান্তরে বিরহ-সর্প দংশন) মৃত্যু হয় লক্ষীপ্রিয়ার। এই ঘটনায় নিমাই মর্মাহত হন। শচীদেবী পুণরায় নিমাইয়ের বিবাহ দিতে চাইলে, নিমাই কিছুতেই পুণর্বার দার পরিগ্রহ করতে চান নি। মায়ের পীড়াপিড়িতে সনাতন পণ্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে বিবাহ হয় ১৫০৭ খ্রীষ্টাব্দে।
১৫০৮ খ্রীষ্টাব্দে পিতৃদেবের পিণ্ডদান করতে গয়াতে যান। পরিচিত হন ঈশ্বরপুরীর সাথে। ১০ অক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন নিমাই। নবদ্বীপে ফিরে বৈষ্ণব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নাম প্রচার মাধ্যমে।
১৫১০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারী কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গুরু তাঁকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে অভিহিত করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর থেকে তিনি লোক-সংগ্রহ উদ্দেশ্যে প্রায় পাঁচ বছর দক্ষিণ-ভারত, পশ্চিম-ভারত ও মথুরা-বৃন্দাবন পরিভ্রমন করেন। ১৫১৫-১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দ, এই আঠারটি বছর পুরীর রাজা প্রতাপ রুদ্রের রাজগুরু কাশী মিশ্রের বাড়ী গম্ভীরায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষ্ণনাম প্রচার করেন। ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে পুরীতে ইহলীলা সম্বরণ করেন।
চৈতন্যদেব তাঁর অনুগামীদের জন্য নিজের হাতে সংস্কৃতে লেখা ‘শিক্ষাষ্টক’ নামে আটটি শ্লোকে উপদেশামৃত রেখে গেছেন, সব শ্লোকেই কৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধাভক্তির কথা রয়েছে। রাধা-নামের কোন উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ‘শিক্ষাষ্টক’ শ্লোকের মধ্যে তৃতীয়তম শ্লোকটি ভক্তজন কণ্ঠে বহুল উচ্চারিত। যথাঃ
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥
যার ভাবার্থ—তৃণকে মাড়িয়ে গেলে তৃণ যেমন প্রতিবাদ করে না, গাছ কাটলে গাছ যেমন প্রতিবাদ করে না, তুমি তাদের চাইতেও সহিষ্ণু হবে। সমাজে যারা অবহেলিত তাদেরও তুমি মান দিয়ে সদা হরির গুণকীর্তন করবে। তাহলে সারমর্ম হলো, তুমি তোমার নিজের জীবনের ক্ষুদ্র মান-অপমান, চাওয়া-পাওয়া সবকিছু উপেক্ষা করে সবাইকে হরি অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রদত্ত আদর্শের গুণকীর্তন করবে।
* * *
চৈতন্যদেবের স্নেহধন্য মুরারী গুপ্ত সংস্কৃত ভাষায় যে লীলা কাহিনী রচনা করেছিলেন সেই গ্রন্থ ‘মুরারী গুপ্তের করচা’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। মহাপ্রভুর বিশেষ স্নেহভাজন, যাঁকে তিনি ‘কবিকর্ণপুর’ আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর নাম ছিল পরমানন্দ। তিনি সংস্কৃত ভাষায় ‘চৈতন্যচরিতামৃতম্’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। চৈতন্যদেবের লীলাবসান পরবর্তীকালে তথ্য সংগ্রহভিত্তিক বাংলা ভাষায় ‘চৈতন্যভাগবত’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন বৃন্দাবন দাস। সমসাময়িক কালে কবি লোচন দাস ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালে কবি জয়ানন্দও ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। ওইসব জীবনীগ্রন্থ থেকে বৃন্দাবনের গোস্বামীগণ নাকি পরিপূর্ণরূপে চৈতন্যদেবকে আস্বাদন করতে পারেন নি, তাই রূপ গোস্বামীর শিষ্য বর্ধমান জেলার ঝামটপুরের বিখ্যাত বৈদ্য, অকৃতদার কৃষ্ণদাস কবিরাজকে নতুন করে এক জীবনীগ্রন্থ রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করলে তিনি পূর্ববর্তী জীবনীকারদের গ্রন্থ এবং অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে নয় বছর ধরে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ শিরোনামে গ্রন্থটি রচনা করেন। যে গ্রন্থটি বৈষ্ণব মহলে প্রামাণ্য রূপে স্বীকৃত হলেও সবক্ষেত্রে ঘটনাপঞ্জীর সন-তারিখ উল্লেখিত হয়নি। গবেষকগণও সকল ঘটনাপঞ্জীর সন-তারিখ নিয়ে একমত হতে পারেন নি। তাই আমিও বিভিন্ন গ্রন্থ পঠন-পাঠন ও গুগল সার্চ করা তথ্যভিত্তিক আনুমানিক সন-তারিখ উল্লেখ করেছি মাত্র।

নিমাই পণ্ডিত, বৈষ্ণব-পণ্ডিত বংশে জন্ম নিয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থানের পণ্ডিত পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও তৎকালিন নবদ্বীপে আচার্য্য শঙ্করের মায়াবাদের সিদ্ধান্তবাগীশদের শুষ্ক জ্ঞানচর্চা, শাক্ত মতবাদের পৌত্তলিকতার পঞ্চ-ম-কারের এবং বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া সাধনা ইত্যাদি সহজীয়া মতবাদের উপাসনার প্রাবল্যের মধ্যে সনাতন ধর্মের প্রচারক প্রকৃত বৈষ্ণবেরা প্রায় উপেক্ষিতই ছিলেন। শাক্তরা সুযোগ পেলেই বৈষ্ণবদের নানাভাবে যাতনা দিতেন, এমনকি ধর্মের নামে পশুবলি দিয়ে পশুর মাংস বাড়িতে ফেলে আসতেন।
বিষ্ণুর উপাসক বৈষ্ণবেরা নবদ্বীপের শ্রীবাস পণ্ডিতের আঙিনায় মিলিত হয়ে কীর্তন করতেন। আর শান্তিপুরের কমলাক্ষ মিশ্রের আঙিনায় বৈষ্ণবদের মিলনমেলা বসতো। বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের উপাসক তৎকালিন বৈষ্ণব প্রধানগণ যথা, শ্রীনিবাস, শুক্লাম্বর, শ্রীমান, মুকুন্দ, বিশ্বরূপ প্রমুখ ভক্তগণ, সেকালের সাধকশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবাচার্য কমলাক্ষ মিশ্র (অদ্বৈত মহাপ্রভু)-এর কাছে তাদের অন্তরের বেদনার কথা বলতেন। অদ্বৈত মহাপ্রভু মথুরার গর্গাচার্যের ন্যায় সনাতন ধর্মের দীনতা থেকে ভক্তদের রক্ষা করতে গঙ্গাজল আর তুলসীমঞ্জুরির নিত্য সেবায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা জানাতেন। পণ্ডিতদের মতে মূলতঃ অদ্বৈত মহাপ্রভুর আরাধনায় শ্রীবিষ্ণু শুদ্ধাত্মা শচীদেবীর মাধ্যমে নিমাই রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হন।

বালক নিমাইয়ের চপলতা এবং তীক্ষ্ণ পাণ্ডিত্যের কাছে ম্লাণ হতে সুরু করে তার্কিক পণ্ডিতদের, শাক্ত পণ্ডিতদের, (অ)বৈষ্ণব পণ্ডিতদের ভ্রান্ত ধারণার পাণ্ডিত্য। তাঁদের দেখলেই শাস্ত্রের ধাঁধাঁ আর ব্যাকরণের ফাঁকি জিগ্যেস করতেন। একদিন ‘‘ওঁ সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’’—মতবাদের তার্কিক পণ্ডিতকে শিক্ষা দিতে তার ভাতে প্রস্রাব করে দেন নিমাই, পণ্ডিত রেগে গিয়ে মারতে এলে নিমাই বলেন, আমার চপলতার জন্য দু’-ঘা মারবেন না হয়, তবুও আমি করজোড়ে বলছি, ব্রহ্মময় জগতে সবই যদি ব্রহ্ম, তবে আপনার ভাতে, আর আমার মুতে ব্রহ্ম কি নেই ! আপনার বিচারে ভাতের ব্রহ্ম আর মুতের ব্রহ্ম কি আলাদা? আলাদাই যদি হয়ে থাকে তাহলে আর আজ থেকে আপনার ওই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে হবে। তবে আমার বুঝ মতে, ব্রহ্ম কারণ, জীব কার্য। ব্রহ্ম পূর্ণ, জীব অংশ। ব্রহ্ম উপাস্য, জীব উপাসক। ব্রহ্ম আর জীব সত্তায় অভেদ, স্বাদে পৃথক।
ব্রহ্মবিজ্ঞতা নিমাইয়ের মুখ থেকে ব্রহ্মকথা শুনে পণ্ডিত তখন বুঝতে পারেন ব্রহ্মের বিশিষ্টতা, বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের তত্ত্ব।
* * *
কিশোর নিমাই যখন টোলে ছাত্র পড়াতেন, সেই সময় কাশ্ম পণ্ডিত কেশবাচার্য দিগ্বিজয় করতে বেড়িয়ে ভারতের সব বিখ্যাত পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে অনেক শিষ্য ও বাহনসহ নবদ্বীপে আসেন। নবদ্বীপের স্মার্ত্ত-পণ্ডিতগণ সুযোগ বুঝে নিমাই পণ্ডিতকে জব্দ করতে পণ্ডিত কেশবাচার্যকে নিমাইয়ের কাছে পাঠান। নিমাইয়ের কাছে গিয়ে কেশবাচার্য বলেন, তুমিই বুঝি নিমাই পণ্ডিত?
নিমাই যথোচিত মর্যাদার সাথে প্রণাম জানিয়ে বলেন, আজ্ঞে, লোকেরা বলেন, কিন্তু আমি নিজেকে পণ্ডিত মনে করি না, শিষ্যদের কিছু পাঠদান করার চেষ্টা করি মাত্র।
—তা’ কি পড়াও?
—কলাপ।
—‘কলাপ’! ও তো শিশুপাঠ্য!
—ওই শিশুপাঠ্যই সঠিক পড়াতে পারছি কি-না, জানি না।
—তাহলে তো আর তোমার সাথে তর্ক করা চলে না!
—শুনেছি আপনি ভারত বিখ্যাত পণ্ডিত, আপনার সাথে তর্ক করার স্পর্দ্ধা যেন না হয়। শুনেছি আপনি সরস্বতী-মাতার বরপুত্র। মুখে মুখে শ্লোক রচনা করেন। অনুগ্রহ করে যদি কিছু নিবেদন করেন, শুনে ধন্য হতাম।
—বলো, কি শুনতে চাও?
—সুরধনী গঙ্গার পবিত্র ধারা বয়ে চলেছে, সে বিষয়ে যদি কিছু নিবেদন করেন। নিমাই বিনীতভাবে বলেন।
পণ্ডিত কেশবাচার্য তৎক্ষণাৎ শত-শ্লোক রচনা দ্বারা গঙ্গার বন্দনা করে গর্বভরে নিমাইকে জিগ্যেস করেন, কি হে নিমাই পণ্ডিত! এতক্ষণ ধরে গঙ্গার মহিমা যা’ বর্ণনা করলাম, কিছু বুঝলে?
নিমাই বিনীতভাবে বললেন, আপনার রচনার অর্থ আপনি না বোঝালে বোঝে কার সাধ্য?
নিমাইয়ের বিনীত ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে কেশবাচার্য বলেন, বলো, কোন্ শ্লোকটা বুঝতে চাও?
নিমাই কেশবাচার্য পণ্ডিতের তাৎক্ষণিক রচনা থেকে—
‘‘মহত্ত্বং গঙ্গায়াঃ সততমিদমাভাতি নিতরাং,
যদেষা শ্রীবিষ্ণোশ্চরণকমলোৎপত্তিসুভগা।
দ্বিতীয় শ্রীলক্ষ্মীরিব সুরনরৈরর্চ্চ্যচরণা,
ভবানীভর্ত্তুর্ষা শিরসি বিভবত্যদ্ভুতগুণা॥’’
(চৈঃ চঃ আদিলীলা, পৃঃ ১২৬)
শ্লোকটি আবৃত্তি করে তার ভাবার্থ জানতে চাইলে পণ্ডিত কেশবাচার্য আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, প্রায় ঝড়ের গতিতে বলা শ্লোক থেকে তুমি এই একটি শ্লোক কণ্ঠস্থ করলে কিভাবে?
নিমাই বিনীতভাবে বলেন, আপনি দৈববলে যেমন মাতা সরস্বতীর বরপুত্র, কবি, আমিও তেমনি একজন শ্রুতিধর।
নিমাইয়ের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে কেশবাচার্য বলেন, তাহলে শোন, এই শ্লোকের ভাবার্থ হচ্ছে—‘‘গঙ্গা, শ্রীবিষ্ণুর চরণকমল থেকে উৎপন্ন হওয়ার কারণে সৌভাগ্যবতী। দ্বিতীয়া শ্রীলক্ষ্মীর ন্যায় দেব ও মানবেরা যাঁর চরণ-পূজায় রত এবং যিনি ভবানীপতি মহাদেবের মস্তকে বিরাজমানা হওয়ার জন্য অদ্ভুত গুণশালিনী হয়েছেন, সেই গঙ্গার এই মহত্ত্ব সর্বদাই নিশ্চিতরূপে প্রত্যক্ষীভূত হয়ে আছে।—বলো, আর কি জানতে চাও?’’
—এবার শ্লোকের দোষ-গুণ বলুন।
—বেদসদৃশ গুণসম্পন্ন অনুপ্রাসযুক্ত উপমারূপ শ্লোকে কোন দোষ নেই, সম্পূর্ণ নির্দোষ। তোমার ব্যাকরণের অলঙ্কার জ্ঞান থাকলে তো তুমি দোষ-গুণ বুঝবে?
—যথার্থই বলেছেন। আমি অলঙ্কার না পড়লেও শুনেছি তো, তা’ থেকেই মনে হচ্ছে আপনার শ্লোক দোষযুক্ত।
—তোমার স্পর্দ্ধা তো কম নয়! ‘কলাপ’ আর ‘ফাঁকি’ পড়া বিদ্যা দিয়ে তুমি আমার শ্লোকের দোষ ধরতে চাও?
—প্রভু, আপনি আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না, আমার ন্যায় অর্বাচীন কি আপনার রোষের উপযুক্ত? মার্জনা করবেন, আমি কিন্ত্তু আপনার রচনায় ৫টি দোষ খুঁজে পেয়েছি, যদি অনুমতি করেন, তাহলে এক-এক করে বর্ণনা করি।
শিষ্যসামন্ত, স্থানীয় বিদ্বজ্জনের সামনে এমন কথা কেউ যে কোনদিন বলবে ভাবতেই পারেন নি কেশবাচার্য, তথাপি তর্কশাস্ত্রের নিয়ম মেনে নিমাইকে বলার জন্য অনুমতি দিলে নিমাই বলেন—-
পঞ্চ দোষ এই শ্লোকে পঞ্চ অলঙ্কার।
ক্রমে আমি কহ শুন করহ বিচার॥
অবিমৃষ্ট বিধেয়াংশ দুই ঠাঞি চিন।
বিরুদ্ধমতি ভগ্নক্রম পুনরাত্ত দোষ তিন॥
গঙ্গার মহত্ত্ব শ্লোকের মূল বিধেয়।
ইদং শব্দে অনুবাদ পশ্চাৎ অবিধেয়॥
বিধেয় আগে কহি পাছে কহিলে অনুবাদ।
এই লাগি শ্লোকের অর্থ করিয়াছে বাদ॥
……………………………………………………
গঙ্গাতে কমল জন্মে সবার সুবোধ।
কমলে গঙ্গার জন্ম অত্যন্ত বিরোধ॥
ইহা বিষ্ণু পাদপদ্মে গঙ্গার উৎপত্তি।
বিরোধালঙ্কার ইহা মহা চমৎকৃতি॥
ঈশ্বর অচিন্ত্য শক্ত্যে গঙ্গার প্রকাশ।
ইহাতে বিরোধ নাহি বিরোধ আভাষ॥
গঙ্গার মহত্ত্ব সাধ্য সাধন তাহার।
বিষ্ণুপাদোৎপত্তি অনুমান অলঙ্কার॥
স্থূল এই পঞ্চ দোষ পঞ্চ অলঙ্কার।
সূক্ষ্ম বিচারিলে যদি আছয়ে অপার॥
(চৈঃ চঃ আদিলীলা, পৃঃ ১২৭-১২৯)
—-হে পণ্ডিতপ্রবর! ‘‘আপনি বিধেয় অর্থাৎ জ্ঞাত আগে বলে পরে অনুবাদ অর্থাৎ অজ্ঞাত বলেছেন। এরফলে শ্লোকের অনুবাদ ঘটেছে, মূল অর্থ বাদ পড়েছে। ‘দ্বিতীয় শ্রীলক্ষ্মী’ রচনায় ‘দ্বিতীয়’ শব্দ বিধেয়, সমাসে গৌণ হওয়াতে শব্দার্থ ক্ষয় হয়ে শব্দটি অপ্রাধান্য রূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। ‘ভব’ অর্থে মহাদেব বোঝালে ‘ভবানী’ অর্থে মহাদেবের স্ত্রীকে বোঝায়। এবং ভবানীর ভর্তা বললেও মহাদেবকে বোঝায়। ‘ভবানীভর্ত্তুর্ষা’ শব্দের প্রয়োগে ‘ভবানীর ভর্তা’-র অর্থ হয়, ভবের পত্নী যে ভবানী তার ভর্তা, যেন ভব ব্যতিরেকে আর একজন ভর্তা বোঝায়, তাই ওই শব্দের প্রয়োগ বিরুদ্ধমতিকারক। শ্রী অর্থে লক্ষ্মী বা শোভাময়ী বোঝায়। এক্ষেত্রে ‘শ্রীলক্ষ্মী’ প্রয়োগে পুনরুক্তবদাভাস অলঙ্কার হয়েছে। আপনি ‘শ্রীবিষ্ণুর চরণ-কমলে গঙ্গার জন্ম’ বোঝাতে চেয়ে ‘কমলে গঙ্গার জন্ম’ বলে ফেলে প্রচলিত সত্যের সাথে বিরোধ করে ফেলেছেন, যদিও তা বিরোধাভাস মাত্র, তাই বিরোধাভাস-অলঙ্কারের প্রয়োগ হয়েছে। ‘গঙ্গার এই মহিমা সর্বদা নিশ্চিতরূপে দেদীপ্যমান, যেহেতু এই গঙ্গা শ্রীবিষ্ণুর চরণকমল হইতে উৎপন্ন হওয়ার কারণে অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী।’—এখানে গঙ্গার মহত্ত্বের সাধন ও সাধ্য দুই-ই পরিলক্ষিত হয়। ওই অনুমান অলঙ্কারের প্রয়োগের ফলে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জড়ীভূত হয়ে গেল।’’
নিমাই পণ্ডিতের বলা ব্যাখ্যান শুনে কেশবাচার্য আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেন, শাস্ত্র না পড়ে, অলঙ্কার না পড়ে আমার শ্লোকের এইরূপ ব্যাখ্যা তুমি কিভাবে করলে?
উত্তরে নিমাই পণ্ডিত বলেন, শাস্ত্রের বিচার আমি জানি না, মাতা সরস্বতী যা’ বলান, তাই বলি। আপনি মহাপণ্ডিত, কবি শিরোমণি, আপনি দুঃখ করবেন না। আপনার শিষ্য মনে করে আমার কিশোর-সুলভ চপলতা ক্ষমা করে দেবেন। আজ চলুন বাসায় ফিরে যাই, কাল আবার মিলিত হয়ে আপনার কাছে শাস্ত্রের বিচার শুনব।

এই মতে নিজ গৃহে গেলা দুই জন।
কবি রাত্রে কৈল সরস্বতী আরাধন॥
সরস্বতী রাত্রে তারে উপদেশ কৈল।
সাক্ষাৎ ঈশ্বর করি প্রভুরে জানিল॥
প্রাতে আসি প্রভুপদে লইল শরণ।
প্রভু কৃপা কৈল তার খণ্ডিল বন্ধন॥
ভাগ্যবন্ত দিগ্বিজয়ী সফল জীবন।
বিদ্যাবলে পায় মহাপ্রভুর চরণ॥

কাশ্মীরি পণ্ডিত নিমাই পণ্ডিতের মধ্যে ষড়ৈশ্বর্য্যের প্রকাশ উপলব্ধি করতে পেরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজে শুধু নয়, ভারতবর্ষের পণ্ডিতসমাজে নিমাই পণ্ডিত একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

নিমাই পণ্ডিত পিতৃদেবের পিণ্ডদান করতে গয়ায় গিয়ে ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা নেবার পর পাণ্ডিত্য ছেড়ে ভক্তিরসে নিজেকে জারিত করলেন। শ্রীবাস অঙ্গনের বৈষ্ণব সভায় যোগদান করে কীর্তনানন্দে মেতে ওঠেন। কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা চৈতন্যদেব আর্য্যকৃষ্টি বিরোধী বৌদ্ধ-তান্ত্রিকতার পৌত্তলিকদের, শুষ্ক জ্ঞানচর্চাকারী তর্কবাগীশদের, তামসিক ধর্মাচ্ছন্নদের উদ্দেশ্যে পথ-নির্দেশ করলেন ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’ কীর্তনের ফরমূলার মাধ্যমে।––তোমার পাপ, তাপ হরণ করতে, প্রবৃত্তির পাপ-তাপের জ্বালা জুড়াতে, সবকিছু ছেড়ে শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শ, শ্রীকৃষ্ণের আদর্শের অনুসরণ কর।
তৎকালিন হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য থাকা সত্বেও তিনি হরেকৃষ্ণ কীর্তনের মাধ্যমে ক্ষত্রিয় বংশজাত রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণের জীবন্ত আদর্শে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে চাইলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অবতারবাদের আদর্শ মেনে।
* * *
কীর্তনগান বাঙালি কবিদের এক অভিনব সৃষ্টি। কৃত্ ধাতু থেকে এসেছে কীর্তন। কৃত্ শব্দের অর্থ প্রশংসা। কীর্তন মানে কীর্তি আলাপন। কীর্তিকর কোন আদর্শের স্মরণ, মনন, গুণ বর্ণন কীর্তনের মূল উদ্দেশ্য। যা’ শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রবেশ করে মানুষের সাত্তিক গুণকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। তাই, মানুষকে সহজে প্রভাবিত করতে, কীর্তন এক সহজ প্রচার মাধ্যম।
কীর্তি-আলাপন দু’-ভাবেই হতে পারে। কথার আদান-প্রদান মাধ্যমে এবং সুরে, ছন্দে, নৃত্যে, যন্ত্রানুষঙ্গের ঐকতানের প্রকাশের মাধ্যমে।
প্রাক চৈতন্যযুগে, খ্রীঃ ১২ শতকে রচিত, শ্রীকৃষ্ণকে নায়ক করে, হ্লাদিনী শক্তিস্বরূপা রাধাকে একজন পরকীয়া নারী রূপে চিত্রণ করে কিছু অশাস্ত্রীয় আদিরসাত্মক পরকীয়া কাহিনী দিয়ে সাজানো, কবি জয়দেব গোস্বামী বিরচিত ‘গীতগোবিন্দম্ কাব্য’ বাংলার কীর্তনের প্রকৃত উৎস।
এ বিষয়ে হিন্দুধর্মের এনসাইক্লোপিডিয়া, ‘পৌরাণিকা’র রচয়িতা অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন— (দ্রঃ গীতগোবিন্দ) ‘‘রামায়ণ ও মহাভারতের কট্টর পটভূমিতে ব্লু-বুক হিসাবে বর্ষবরদের চরম ও পরম পরিতৃপ্তি দিয়েছিল; তন্ত্রাভিলাষী সমাজে তন্ত্রগুলি চেতন ও অবচেতন মনকে যেমন তৃপ্তি দেয়।’’ কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের মূল্যায়ন বিষয়ে বলছেন—‘‘গীতগোবিন্দে সুড়সুড়ি আছে আর আছে দুষ্পাচ্য যৌনতা। ….. সহজিয়া জয়দেব আবিল, অপাঠ্য।’’ রাধা সন্দর্ভে বলছেন— ‘‘…. রাধাবাদ শক্তিবাদেরই একটি ধারা; রাসলীলা নিরোধ ব্যবহারের বিশুদ্ধ বিজ্ঞাপন। তন্ত্রের মানসকন্যা রাধা। রস ও রতির মিলন বৈষ্ণব তত্ত্ব; সাধক ও ভৈরবীর সম্ভোগ শাক্ত তত্ত্ব এবং বজ্রযানে বজ্র ও পদ্মের মিলন এ সবগুলিই তান্ত্রিক তত্ত্ব; বজ্রযানে তাই বলা হয়েছে বুদ্ধত্বং যোষিৎ-যোনিপ্রতিষ্ঠিতম্। ….. ভাগবতে রাধা নাই। …. ভাগবত ও বিষ্ণু পুরাণে রাসলীলা আছে কিন্তু রাধা নাই। ….. ’’
তথাপি রাধার মানবী অস্তিত্ব কিছু-কিছু অ-বৈষ্ণবদের রিরংসায় বাসা বেঁধেছিল। সেই বিকৃত ধারার বাসাটাকে ভাঙতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব নিজেকে রাধা-কৃষ্ণের যুগলরূপ বলে প্রচার করলেন। যাতে ধর্মের অজুহাতে ধর্মবিরুদ্ধ পরকীয়া-প্রীতি প্রশ্রয় না পায়। তাই তিনি রাধাকে নারীদেহে নয়, সুরত-সম্বেগের ধারায় অন্বেষণ করতে পথ দেখালেন। রাধাকৃষ্ণের যুগলধারার আদর্শে, পরকীয়া-প্রীতির আদর্শে গড়ে ওঠা তৎকালিন প্রচলিত কীর্তনের ধারাটাকে গীতা গ্রন্থে বর্ণিত—
“যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লাণির্ভবতি ভারতঃ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনম্ সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম্ ।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥”–এর সূত্র মেনে,—অর্থাৎ ‘‘ঈশ্বর এক, ধর্ম এক, প্রেরিতগণ বিভিন্ন নামে সেই এক-এরই বার্তাবাহী’’র সনাতনী ধারা বা সনাতন ধর্মকে সংস্থাপিত করলেন। শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণের আদর্শকে সামনে রেখে। হরেকৃষ্ণ, হরেরাম প্রচার মাধ্যমে। এর ফলে পরকীয়া-তত্ত্বের সহজীয়া মতবাদীরা বৈষ্ণবীয় মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ পেল এবং পৌত্তলিকতার নাগপাশ থেকে সনাতন ধর্মকে উদ্ধার করে এক সর্বজনীন রূপ দিলেন। মূলতঃ শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। নিজেকে অন্তরালে রেখে।
‘অবতার নাহি কহে, আমি অবতার।’ তথাপি ধরা পড়ে গেলেন বৈষ্ণবাচার্য সাধক অদ্বৈত মহাপ্রভুর কাছে। অদ্বৈত মহাপ্রভুকে ফাঁকি দিতে পারলেন না। তাঁর সাধনার কাছে ধরা পড়ে গেলেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুও বুঝতে পেরে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের নব-কলেবর রূপে প্রচার করতে শুরু করলেন।
* * *
আসলে সমগ্র জগতের প্রাণনশক্তি বা প্রাণপঙ্ক বা প্রটোপ্লাজমকে পরমাত্মিক শক্তি বলা হয়, যা বিশ্ব ব্যাপিয়া বিদ্যমান, ‘‘যিনি সর্ব্ব ও প্রত্যেকের ভিতর বিশেষভাবে পরিব্যাপ্ত’’ তিনিই বিষ্ণু। যে পুরোহিতগণ প্রতিমা পূজা করেন, তাঁরাও সর্বাগ্রে ‘ওঁ শ্রীবিষ্ণু’ মন্ত্রে আচমন করেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত রঘুবংশের কৌলগুরু বশিষ্ঠদেব শ্রীরামচন্দ্রকে ‘‘ওঁ নারায়ণঃ পরাবেদা নারায়ণঃ পরাক্ষরঃ।/নারায়ণঃ পরামুক্তি নারায়ণঃ পরাগতিঃ॥’’ মন্ত্রে স্বস্তিবাচন করার সময় শ্রীরামচন্দ্রের মধ্যে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণকে উপলব্ধি করলে তিনি নারায়ণের পরিবর্তে রামচন্দ্র শব্দ বসিয়ে মন্ত্রটিকে পরিমার্জিত করেন। নররূপী নারায়ণ পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে কেন্দ্র করে সবাইকে ধর্ম পালন করতে উদ্বুদ্ধ করলেন। অনুরূপভাবে কৃষ্ণনামের প্রচারক শ্রীগৌরাঙ্গদেবের মধ্যে বিষ্ণুত্ব বা কৃষ্ণত্ব-এর পরিপূর্ণতা সাধনদ্বারা উপলব্ধি করা মাত্রই নিত্যানন্দ প্রভু ‘‘ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম রে …. ।’’ ‘‘প্রভু নিত্যানন্দ কহে দন্তে তৃণ ধরি। আমারে কিনিয়া লহ ভজ গৌরহরি॥ ইত্যাদি স্বস্তিবাচনে গীতার অবতারবাদকে সম্মান জানালেন। তৎকালিন পুরুষোত্তম চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে সবাইকে চলতে বললেন। এই হচ্ছে সাজা-গুরুদের কবল থেকে সনাতন বৈষ্ণবধর্মের ধারাকে নবীকরণ মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার ফরমূলা। গীতা গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়টিকে স্পষ্ট করে বিধৃত করেছেন।

  • * *
    অবতার-তত্ত্বের ধারা অনুসারে অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন সত্যের পূজারী অথচ অসৎ নিরোধী। তৎকালীন যুগের অচ্ছুৎ অনার্য্যদের আর্য্যীকৃত করে আর্য্য-অনার্য্যদের মেলবন্ধন করলেন। অনার্য্য গুহক চণ্ডালকে করলেন মিত্র, আবার অকালমৃত্যুর দ্যোতক বর্ণাশ্রম-বিদ্বেষী প্রতিলোমাচারী বন্ধুবর শম্বুককে দিলেন চরম শাস্তি। ব্রাহ্মণ ঔরসজাত রাবণ যখন কিছুতেই সীতাকে বশে আনতে পারছিলেন না তখন সভাসদেরা মায়াবী-রাবণকে বলেছিলেন, আপনি রামরূপ ধারণ করে গেলেই তো সীতাকে সহজেই বশীভূত করতে পারেন। উত্তরে রাবণ বলেছিলেন, ওই রূপ স্মরণ করলেই আমার সব পাপ-প্রবৃত্তি মুছে গিয়ে আমি এক অন্য মানুষ হয়ে যাই। তথাপি প্রবৃত্তির ঊর্দ্ধে উঠে ওই বোধটাকে ধরে রাখতে পারল না, ফলে রামচন্দ্রের হাতে হত হতে হল। অথচ বিভীষণ রামচন্দ্রের আদর্শে প্রলুব্ধ হয়ে রাবণকে ত্যাগ করলেন।
    এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, ……রাবণ তো আদর্শবান ছিল না। রামচন্দ্রকে দেখে সে একেবারে বিগলিত হয়ে গেল। রামচন্দ্রের ঊর্দ্ধে তার আর কেউ নেই। ভ্রাতার প্রতি কর্তব্যের চাইতে তার ইষ্টানুরাগই প্রবল। ভীষ্ম কিন্তু কেষ্টঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়েও, কর্তব্যবোধে কৌরবের পক্ষ ছাড়তে পারেন নি। তা কিন্তু ঠিক হয়নি। ইষ্টের জন্য, সত্যের জন্য, অন্য যে-কোন কর্তব্য ত্যাগ করতে হবে, যদি সে কর্তব্য ইষ্টের পথে অন্তরায় হয়। ‘‘সর্ব্বধর্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’’ । (আ. প্র. 21/2.6.1952)
    ……শ্রীরামচন্দ্রের খুব strong group (শক্তিমান দল) ছিল। হনুমান, সুগ্রীব, জাম্বুবান, অঙ্গদ, নল, নীল এরা সবাই ছিল একটা strong unit (শক্তিমান গুচ্ছ)। রামচন্দ্রের সাথে ওদের একজন না-একজন থাকতই। এক সময় বিভীষণকে সন্দেহ করেছিল লক্ষণ। বিভীষণ তাতে বলেছিল, ‘আমি জানি তোমরা আমাকে সন্দেহ করবে। কারণ, আমি রাবণের ভাই। আমি ভাই হয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে treachery (বিশ্বাসঘাতকতা) করেছি। কিন্তু করেছি অসৎ-এর বিরুদ্ধে। হজরত রসুলের group-ও (দলও) খুব strong (শক্তিমান) ছিল। তিনি বেঁচে থাকতে-থাকতেই অনেকখানি ভূখণ্ডের king (রাজা) হয়েছিলেন। (দীপরক্ষী 2/26.7.1956)
    রাজাকে কতখানি প্রজাস্বার্থী হতে হবে সেইটেই রামচন্দ্র দেখিয়েছেন। প্রজা প্রাণের চাইতেও বেশী না হলে রাজা হওয়া যায় না। …….সীতাও ছিলেন রামচন্দ্রের আদর্শে উৎসর্গীকৃত। আর এই ছিল আমাদের আর্য্যবিবাহের তাৎপর্য্য। (আ. প্র. 20/9. 8. 1951)
    অবতার বরিষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, ‘‘শ্রীকৃষ্ণ সব সময়েই চেষ্টা করেছেন যুদ্ধবিগ্রহ avoid (পরিহার) করতে, কিন্তু তাঁর environment (পরিবেশ) তাঁকে সে scope (সুযোগ) দিল না। আর শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ—মৃত্যুকে মারবার জন্য। Gangrene-affected part of the body (শরীরের দুষ্টক্ষতযুক্ত স্থান) আমরা যেমন কেটে ফেলি জীবন বাঁচাবার জন্য, তিনিও তেমনি মৃত্যু ও মারণের মূর্ত্ত প্রতীকস্বরূপ যারা ছিল তাদের মেরেছিলেন সমগ্র সমাজকে বাঁচাবার জন্য। (আ. প্র. খণ্ড ১, ৪. ১২. ১৯৪১)
    …… শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে বুঝিয়ে দিলেন যে devil (শয়তান) যদি রাজত্ব করে, তবে অর্জ্জুনের ঈপ্সিত ধর্ম্ম, জাতি, কুল, মান কিছুই রক্ষা পাবে না। তাই devil (শয়তান)-কে demolish (ধ্বংস) করা লোকমঙ্গলের জন্যই অপরিহার্য্য। এর মধ্যে দ্বেষ-হিংসার বালাই নেই। বরং অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধকে এড়িয়ে চলার বুদ্ধির পিছনে আছে দুর্ব্বলতা।’’ (আ. প্র. খণ্ড ৬, ৬. ১২. ১৯৪৫)
    কেষ্টদা (ভট্টাচার্য্য) প্রশ্ন করেন– গীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে এক বিরাট দার্শনিক আলোচনার অবতারণা করে তারপর ক্ষত্রিয়ের করণীয় নির্দ্দেশ করলেন অর্জুনকে। ওভাবে বললেন কেন ?
    শ্রীশ্রীঠাকুর– Divine Philosophy ( ভাগবত দর্শন ) দিয়ে শুরু করে তা থেকে Concrete – এ ( বাস্তবে ) আসলেন। আত্মিক ধর্ম প্রত্যেকে পালন করতে হয় তার Instinctive activity ( সহজাত সংস্কার-সম্মত কর্ম ) এর ভিতর দিয়ে। অর্জ্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছিলেন তার মর্ম্ম হল — You are a Kshatriya, born with Kshatriya instincts. And you must do your instinctive duty with all elevating urge ( তুমি ক্ষাত্র সংস্কার নিয়ে জাত ক্ষত্রিয়। এবং উন্নয়নী আকুতি নিয়ে তোমাকে অবশ্যই তোমার সহজাত সংস্কার-সম্মত কর্তব্য পালন করতে হবে )। অর্জ্জুন পন্ডিত কিনা তাই কেষ্টঠাকুর ঐভাবে অর্জ্জুনকে তাঁর বক্তব্য বলেছিলেন। Philosophy ( দর্শন ) না বললে অর্জ্জুন ধরত না।
    (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১১দশ খন্ড, (ইং ২০-০৫-১৯৪৮)
    রামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই বৈষ্ণবধর্মের বা সনাতন ধর্মের মূল কাঠামো সদাচার এবং বর্ণাশ্রমকে রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। চৈতন্যদেবও ভারতীয় কৃষ্টির মূল, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম পালন করার পর লোকশিক্ষার জন্য সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তিনি বাস্তব জীবনে অসৎ-নিরোধে তৎপর ছিলেন। বর্ণাশ্রম বিরোধী কোন প্রতিলোম বিবাহ পর্যন্ত হতে দেন নি। দোর্দন্ডপ্রতাপ জমিদারের দুষ্কৃত ভাইপো মাধবের কবল থেকে চন্দনের বাগদত্তা চুয়াকে পার্ষদদের সাহায্যে চন্দনকে দিয়েই হরণ করিয়ে স্বয়ং পৌরহিত্য করে উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করেছেন। (সূত্রঃ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত, চুয়াচন্দন উপন্যাস)
  • * *
    বাংলার বিশুদ্ধ কীর্তন-আন্দোলনের পথিকৃৎ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি স্বভাবজ পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে নবদ্বীপের স্মার্ত্ত পণ্ডিতদের, ভারতখ্যাত কাশ্মীরি-পণ্ডিতের দর্প চূর্ণ করেছেন। তিনি তামসিক গুণসম্পন্ন সমাজের প্রতিনিধি জগাই-মাধাইদের প্রেম দিয়ে সাত্তিক গুণের উদ্বোধন করেছেন। সনাতন ধর্ম বিদ্বেষী চাঁদ কাজীদের হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে চরমবার্তা দিয়ে তমোগুণ নাশ করে ইসলামের বিকৃতি প্রচারকে নস্যাৎ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাহ্য জাতিভেদের বেড়াজাল অগ্রাহ্য করে, যবন হরিদাসের ভক্তিকে মর্যাদা দিয়ে ভক্ত হরিদাসে রূপান্তর করেছেন। তৎকালিন ভারতের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পণ্ডিতদের, যেমন রায় রামানন্দ, প্রকাশানন্দ সরস্বতী, সার্ব্বভৌম প্রভৃতিদের ভুল ভাঙাতে তথ্যসমৃদ্ধ বাচনিক কীর্তি—
    ‘‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ।’’
    ‘‘মুচি যদি ভক্তিসহ ডাকে কৃষ্ণধনে।
    কোটি নমস্কার করি তাহার চরণে॥’’—-প্রকাশ মাধ্যমে আপামর সবাইকে সনাতন ধর্মে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
    এ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, ‘‘চৈতন্যদেবও জগাই-মাধাইয়ের উপর কেমন উগ্রভাব ধারণ করে তাদের অন্তরে ত্রাস ও অনুতাপ জাগিয়ে তবে প্রেম দেখিয়ে তাদের অন্তর জয় করেছিলেন। তাদের উগ্রদম্ভ, দর্প ও প্রবৃত্তি-উন্মত্ততাকে স্তব্ধ না করে, আয়ত্তে না এনে গোড়ায় প্রেম দেখাতে গেলে সে-প্রেম তারা ধরতে পারত না। হয়তো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত।’’
    (আ. প্র. ৯/২৭. ১২. ১৯৪৬)
    প্রকাশানন্দ সরস্বতী, সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য প্রমুখগণ বৈদান্তিক পণ্ডিত ছিলেন। তাঁদের পাণ্ডিত্য বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন,—- বৈদান্তিক ভাব মানে record of experience (জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দলিল)। ওরা হয়তো achieve (আয়ত্ত) করার পথ ঠিক অবলম্বন করেননি, সেইটে চৈতন্য মহাপ্রভু ধরিয়ে দিয়েছেন। ভক্তি লাগেই, ভক্তিপথ সহজ, সুষ্ঠু, accurate (যথাযথ), ভক্তির রাস্তা দিয়েই যেতে হয়, তার সঙ্গে বৈশিষ্ট্যানুযায়ী ঝোঁক থাকেই। অদ্বৈতবাদেও গুরুভক্তির উপর জোর দেওয়া আছে। নইলে এগোন যায় না। তাই আছে— ‘অদ্বৈতং ত্রিষু লোকেষু নাদ্বৈতং গুরুনা সহ’। নির্ব্বিকল্প সমাধিতে অদ্বৈতভূমিতে সমাসীন হ’লে জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা লয় পেয়ে যায়। তখন মানুষ বোধস্বরূপ হ’য়ে থাকে, সে অবস্থা মুখে বলা যায় না। অন্য সময় সে মানুষেরও সেব্য-সেবকভাব নিয়ে থাকা স্বাভাবিক! আমি না থাকলে তুমি থাকে না, তুমি না থাকলে আমি থাকে না। জীবজগতের সঙ্গে ব্যবহারে যে আমি-তুমি রূপ দ্বৈতভাব থাকে, তখনও তার মধ্যে একটা একাত্মবোধের চেতনা খেলা ক’রে বেড়ায়। ইষ্টই যে সব-কিছু হ’য়ে আছেন, এই স্মৃতি লেগে থাকে। আত্মাই কই আর ব্রহ্মই কই, তার মূর্ত্ত বিগ্রহ হলেন ইষ্ট। মানুষ যখন ইষ্টসর্ব্বস্ব হয়, ইষ্টপ্রীত্যর্থে ছাড়া যখন সে একটা নিঃশ্বাসও ফেলে না, তখনই সে একই সঙ্গে ভক্তিযোগ, কর্ম্মযোগ ও জ্ঞানযোগে সিদ্ধ হ’য়ে ওঠে। কর্ম্মযোগ, জ্ঞানযোগ যাই বল, ভক্তির সঙ্গে যোগ না থাকলে কাজ হয় না, সব যোগই আসে ভক্তিযোগ থেকে—
    “বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্ মাং প্রপদ্যতে, বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ”। এই জ্ঞানী একাধারে জ্ঞানী, ভক্ত ও কর্ম্মী। গোড়া থেকেই অদ্বৈতবাদ mathematically (গাণিতিকভাবে) সম্ভব হ’তে পারে, practically (বাস্তবে) সম্ভব হয় কমই। (আলোচনা প্রসঙ্গে, ত্রয়োদশ খণ্ড, তাং ১-৮-১৯৪৮)
  • * *

চৈতন্যদেব অসি নয়, তীর-ধনুক-বল্লম লাঠি দিয়েও নয়—খোল, করতালাদি বাদ্যযন্ত্রের অনুষঙ্গে ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’ নামকীর্তনের মাধ্যমে এক ধর্মীয় প্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ অতিক্রম করে, পুরুষার্থের পঞ্চম-বর্গ প্রেমের সাহায্যে সাম্প্রদায়িক কায়েমী-স্বার্থীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ভাগবত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভাগবত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্ণাশ্রমানুগ সামাজিক বিন্যাসকে সমৃদ্ধ করতে সর্ববর্ণে হরিনাম প্রচার করে বাহ্য জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কিছু স্বার্থান্বেষী স্মার্ত্ত-পণ্ডিতদের অভিসন্ধিমূলক অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালিন শাসক চাঁদকাজী হরিনাম সঙ্কীর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শ্রীবাস অঙ্গনের কীর্তনের আসরে গিয়ে বৈষ্ণবদের ওপর অত্যাচার করে, শ্রীখোল ভেঙ্গে দেয়। শান্ত মহাপ্রভু ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে কোন বিরোধ না করেই দুর্বার নিরোধ করেছিলেন। ১৪টি কীর্তনদল সংগঠিত করে উদ্দাম কীর্তন করতে করতে চাঁদকাজির বাড়িতে যান। চাঁদকাজী ভয় পেয়ে গেলে মহাপ্রভু তাকে আশ্বস্ত করতে কৃষ্ণপ্রেমের কথা বলেন। হরিনাম-সংকীর্তনের উপযোগিতা বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেন। তার পরে আপনকরা ভাব নিয়ে বলেন, তুমি আমার মামার গ্রামের লোক হবার সুবাদে তুমি আমার মামা হও, মামা হয়ে ভাগ্নের প্রতি এমন কঠোর হয়ো না। কীর্তন বন্ধ করার আদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আমরা তোমার বাড়ী ছেড়ে যাচ্ছি না। ধর্ম প্রতিষ্ঠার কর্তব্যে অটল মহাপ্রভুর কীর্তন আন্দোলনের কাছে আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয় চাঁদকাজি। তিনিও মহাপ্রভুর সাথে গলা মিলিয়ে হরিনাম সঙ্কীর্তন করেন। সবাইকে হরিনাম সঙ্কীর্তন করতে আদেশ জারী করেন।
চৈতন্য আজ্ঞায় স্থির হইল কীর্তন
কহে আপনার তত্ত্ব করিয়া গর্জন।
কলিযুগে মুঞি কৃষ্ণ নারায়ন
মুঞি সেই ভগবান দেবকীনন্দন।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কোটি মাঝে মুই নাথ
যত গাও সেই মুঞি তোরা মোর দাস।।’’
(শ্রীচৈতন্য ভাগবত পৃষ্ঠা ১৪৬, মধ্যখণ্ড ৮ম অধ্যায়।)
“গৌড়েশ্বর নবাবের দৌহিত্র চাঁদকাজী কে ভগবান শ্রীমন্ মহাপ্রভুর কৃপা”– (৩)

  • প্রভু কহে – প্রশ্ন লাগি আইলাম তোমার স্থানে।
    কাজী কহে-আজ্ঞা কর যে তোমার মনে।। ১৪৬
    অনুবাদ :- শ্রীমন্ মহাপ্রভু বললেন, মামা! আমি আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করার জন্য আপনার বাড়িতে এসেছি।
    তার উত্তরে চাঁদকাজী বললেন – হ্যা, তোমার মনে কি প্রশ্ন আছে তা তুমি বল।
  • প্রভু কহে – গোদুগ্ধ খাও গাভী তোমার মাতা।
    বৃষ অন্ন উপজায় তাতে তেঁহো পিতা।। ১৪৭
    অনুবাদ :- শ্রীমন্ মহাপ্রভু বললেন – আপনি গরুর দুধ খান; সেই সূত্রে গাভী হচ্ছে আপনার মাতা। আর বৃষ অন্ন উৎপাদন করে, যা খেয়ে আপনি জীবন ধারন করেন; সেই সূত্রে সে আপনার পিতা।
  • পিতা মাতা মারি খাও এবা কোন্ ধর্ম।
    কোন্ বলে কর তুমি এমত বিকর্ম।। ১৪৮
    অনুবাদ :- যেহেতু বৃষ ও গাভী আপনার পিতা ও মাতা, তা হলে তাদের হত্যা করে তাদের মাংস খান কি করে ? এটি কোন্ ধর্ম ? কার বলে আপনি এই পাপকর্ম করছেন ?
  • কাজী কহে – তোমার যৈছে বেদ পুরাণ।
    তৈছে আমার শাস্ত্র কেতাব কোরাণ।। ১৪৯
    অনুবাদ :- কাজী উত্তর দিলেন, তোমার যেমন বেদ, পুরাণ আদি শাস্ত্র রয়েছে, তেমনই আমাদের শাস্ত্র হচ্ছে কোরান।
  • সেই শাস্ত্রে কহে প্রবৃত্তি নিবৃত্তি মার্গ-ভেদ।
    নিবৃত্তি-মার্গে জীব মাত্র বধের নিষধ।। ১৫০
    অনুবাদ :- কোরন অনুসারে উন্নতি সাধনের দুটি পথ রয়েছে – প্রবৃত্তিমার্গ ও নিবৃত্তিমার্গ। নিবৃত্তিমার্গে জীবহত্যা নিষিদ্ধ।
  • প্রবৃত্তি-মার্গে গোবধ করিতে বিধি হয়।
    শাস্ত্র আজ্ঞায় বধ কৈলে নাহি পাপ ভয়।। ১৫১
    অনুবাদ :- প্রবৃত্তিমার্গে গোবধ অনুমোন করা হয়েছে। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে যদি বধ করা হয়, তাহলে কোনম পাপ হয় না।
  • তোমার বেদেতে আছে গোবধের বাণী।
    অতএব গোবধ করে বড় বড় মনি।। ১৫২
    অনুবাদ :- চাঁদকাজী শ্রীমন্ মহাপ্রভু বললেন – তোমার বৈদিক শাস্ত্রে গোবধের নির্দেশ রয়েছে। সেই শাস্ত্র-নির্দেশের বলে বড় বড় মুনিরা গোমেধ-যজ্ঞ করেছিলেন।
  • প্রভু কহে – বেদে কহে গোবধ নিষেধে।
    অতএব হিন্দুমাত্র না করে গোবধে।। ১৫৩
    অনুবাদ :- চাঁদকাজীর উক্তি খণ্ডন করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন – বেদে স্পষ্টভাবে গোবধ নিষধ করা হয়েছে। তাই যে কোন হিন্দু, তা তিনি যেই হোন না কেন, কখনোও গোবধ করেন না।
  • জীয়াইতে পারে যদি তবে মারে প্রাণী।
    বেদ-পুরাণে আছে হেন আজ্ঞাবাণী।। ১৫৪
    অনুবাদ :- বেদ ও পুরাণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, কেউ যদি কোন প্রাণীকে নবজীবন দান করতে পারে, তাহলে গবেষণার উদ্দ্যেশে সে প্রাণী মারতে পারে।
  • অতএব জরদগব মারে মুনিগণ।
    বেদমন্ত্রে শীঘ্র করে তাহার জীবন।। ১৫৫
    অনুবাদ :- তাই মুনি-ঋষিরা অতি বৃদ্ধ জরদগব (জরাগ্রস্ত বা বৃদ্ধ) পশুদের কখনও কখনও মেরে, বৈদিক মন্ত্রের সাহায্যে তাদের নবজীবন দান করতেন।
  • জরদগব হঞা যুবা হয় আর বার।
    তাতে তার বধ নহে হয় উপকার।। ১৫৬
    অনুবাদ :- এই ধরনের জরদগব (জরাগ্রস্ত বা বৃদ্ধ) পশুদের যখন এভাবেই নবজীবন দান করা হত, তাতে তাদের তাতে তাদের বধ করা হত না, পক্ষান্তরে তাদের মহা উপকার সাধন করা হত।
  • কলিকালে তৈছে শক্তি নাহিক ব্রাহ্মণে।
    অতএব গোবধ কেহো না করে এখনে।। ১৫৭
    অনুবাদ :- পূর্বে মহা শক্তিশালী ব্রাহ্মণেরা বৈদিক মন্ত্রের সাহায্য এই ধরনের কার্য্য সাধন করতে পারতেন, কিন্তু এখন এই কলিযুগে সেই রকম শক্তিশালি কোন ব্রাহ্মণই নেই। তাই গাভী ও বৃষদের নবজীবন দান করার যে গোমেধ-যোজ্ঞ, তা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
  • তোমরা জীয়াইতে নার বধ মাত্র সার।
    নরক হৈতে তোমার নাহিক নিস্তার।। ১৫৮
    অনুবাদ :- তোমরা মুসলমানেরা পশুকে নবজীবন দান করতে পার না, তোমারা কেবল হত্যা করতেই পার। তাই তোমরা নরকগামী হচ্ছ; সেখান থেকে তোমরা কোনভাবেই নিস্তার পাবে না।
  • গরুর যতেক রোম, তত সহস্র বৎসর।
    গোবধী রৌরব মধ্যে পচে নিরন্তর।। ১৫৯
    অনুবাদ :- গরুর শরীরে যত লোম আছে তত হাজার বছর গোহত্যাকারী রৌরব নামক নরকে অকল্পনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে।
  • তোমাসভার শাস্ত্রকর্তা-সেহো ভ্রান্ত হৈল।
    না জানি শাস্ত্রের মর্ম ঐছে আজ্ঞা দিল।। ১৬০
    অনুবাদ :- তোমাদের শাস্ত্রে বহু ভুলভ্রান্তি রয়েছে। শাস্ত্রের মর্ম না জেনে, সে সমস্ত শাস্ত্রর প্রণয়নকারীরা এমন ধরনের নির্দেশ দিয়েছে, যাতে যুক্তি বা বুদ্ধির দ্বারা বিচারের কোন ভিত্তি নেই এবং প্রমাণও নেই।
  • শুনি স্তব্ধ হৈল কাজী না স্ফুরে বাণী।
    বিচারিয়া কহে কাজী পরাভব মানি।। ১৬১
    অনুবাদ :- শ্রীমন্ মহাপ্রভুর এই কথা শুনে কাজীর সমস্ত যুক্তি স্তব্ধ হল, তিনি আর কিছু বলতে পারলেনা। এভাবেই পরাজয় স্বীকার করে কাজী বিচারপূর্বক বললেন—
  • তুমি যে কহিলে পণ্ডিত সেই সত্য হয়।
    আধুনিক আমার শাস্ত্র, বিচার-সহ নয়।। ১৬২
    অনুবাদ :- নিমাই পণ্ডিত! তুমি যা বললে তা সবই সত্য। আমাদের শাস্ত্র আধুনিক এবং তাই তার নির্দশগুলি দার্শনিক বিচার বা যুক্তিসঙ্গত নয়।
  • কল্পিত আমার শাস্ত্র আমি সব জানি।
    জাতি-অনুরোধে তবু সেই শাস্ত্র মানি।। ১৬৩
    অনুবাদ :- আমি জানি যে, আমাদের শাস্ত্র বহু ভ্রান্ত্র ধারনা ও কল্পনায় পূর্ণ, তবুও যেহেতু আমি মুসলমান, তাই সম্প্রদায়ের খাতিরে আমি সেগুলি স্বীকার করি।
    (শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।)

সনাতন ধর্মকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে এত কিছু করা সত্বেও নবদ্বীপের কিছু স্মার্ত্ত পণ্ডিতেরা মহাপ্রভুর বিরোধিতা করেছেন। তাই তিনি অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হয়ে বৈষ্ণব আন্দোলনকে নবদ্বীপে বা নদীয়াতে সীমাবদ্ধ না রেখে ভারতব্যাপী বিস্তার করার মানসে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে ভুষিত হয়ে লোক-সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়েন।
“সন্ন্যাস লইনু যবে ছন্ন হইল মন।
কী কাজ সন্ন্যাসে মোর প্রেম প্রয়োজন॥”
—এই বাণীর মধ্যে যা’ স্পষ্টরূপে প্রকাশিত।
* * *
চৈতন্যদেবের লীলাবসান পরবর্তীকালে কিছু প্রবৃত্তিমার্গী অনুগামীরা চৈতন্যদেব কথিত অবতারবাদের মূলমন্ত্র—
“আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা, ধরে প্রেম নাম।
কামের তাৎপর্য্য নিজ সম্ভোগ কেবল।
কৃষ্ণসুখ তাৎপর্য্য প্রেম মহাবল।।”
একটু বোধী তাৎপর্যে বিচার করলে দেখা যাবে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-র আদর্শের অনুশাসন অনুশীলন ভিন্ন “কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা” উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
‘‘কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা’’-র সদাচার, বর্ণাশ্রম ও চতুরাশ্রম-ধর্মের তাৎপর্য্য বোঝার চেষ্টা না করে, কৃষ্ণের আদর্শ চরিত্রগত করার অনুশীলন না করে, সাধনদ্বারা চৈতন্যদেবের পরবর্তী অবতারকে অন্বেষণ না করে, প্রবৃত্তি পরবশতার “আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা”-কে গুরুত্ব দিলেন তথাকথিত শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য-প্রেমীরা। শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধাকে জুড়ে নিয়ে মুখে ‘কৃষ্ণ-কৃষ্ণ’ বলে খোল-করতাল সহযোগে কীর্তন করতে অভ্যস্ত হলেন। রাধা-কৃষ্ণের পরকীয়া প্রীতির সহজিয়া গোষ্ঠী তৈরি করে সগোত্র এবং প্রতিলোম বিবাহাদি সমর্থন করে আশ্রমধর্মকে অশ্রদ্ধা করেছেন। ফলে বিকৃত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্যদেবের আদর্শ। যার প্রবহমানতা বর্তমানেও বিদ্যমান। চৈতন্যদেব প্রদত্ত ‘শিক্ষাষ্টক’ উপদেশামৃত, যার মধ্যে ‘রাধা’ নামের উল্লেখ পর্যন্ত নেই, ওই উপেদেশামৃতকে গুরুত্বের সাথে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থেও রাধাকে মানবী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। রাধাকে কৃষ্ণের বল্লভা বলা হয়েছে। বল্লভা শব্দের অর্থ প্রণয়িণী। যে কৃষ্ণকে সবকিছুর স্রষ্টা মনে করেন যারা, যে কৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখান বলে প্রচার করা হয়, সেই কৃষ্ণের প্রাণধন, প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তির উৎস একজন নারী ! ভাবা যায় ! না মেনে নেওয়া যায় ? যদি রাধাকে কৃষ্ণের একজন ভক্ত হিসাবে দেখাতেন, তাহলে মেনে নেওয়া যেত।
রাধা সহ ক্রীড়ারস বৃদ্ধির কারণ।
আর সব গোপীগণ রাসোপকরণ॥
কৃষ্ণের বল্লভা রাধা কৃষ্ণ প্রাণধন।
তাঁহা বিনু সুখ হেতু নহে গোপীগণ॥
(চৈঃ চঃ পৃঃ ৬৪)
শুধু তাই নয়, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে গবেষণা করেন যারা, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে নিয়ে গবেষণা করেন যারা, তারাও পার্থসারথী কৃষ্ণের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে, বর্ণাশ্রমধর্মকে উপেক্ষা করে, বাঁশী হাতে নিয়ে রাধাকে জড়িয়ে ধরা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির উপাসনা করেন। ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘ’, সংক্ষেপে ইসকনের ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি স্মরণে জন্মাষ্টমীর দিনটিতেও রাধাকে সাথে রাখেন, যেন রাধাকে সাথে নিয়েই কৃষ্ণ জন্মেছিলেন!

    বর্তমান পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন—‘‘শুনেছি ভাগবতে রাধা ব'লে গোপিনী নেই। আমি বুঝি, রাধা মানে সেরা সৃষ্টি-রচয়িতা শক্তি। শব্দের থেকেই সব। কতরকমের শব্দ শোনা যায়। ওঁ-অনুভূতির পূর্বে দারুণ বম্ বম্ বম্ শব্দ হয়। দুনিয়াটা যেন ফেটে চৌচির হ'য়ে যাবে। কিছু থাকবে না, সব ধ্বংস হ'য়ে যাবে। সত্তাকেও বিলুপ্ত ক'রে দেবে। এমন শব্দ, সব যেন টুকরো টুকরো হ'য়ে, রেণু রেণু হ'য়ে উড়ে যাবে। সে কী ভীষণ অবস্থা! ভয় বলি, সত্তার ভয় যে কী তখন বোঝা যায়! সত্তা বুঝি এই মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দিল। তখন বোঝা যায় দয়ালের দয়া, যে দয়ায় টিকে আছি এই দুনিয়ায়। ওঁ-অনুধাবনে রং আসে। রং-এ মনোনিবেশ করলে পিকলু বাঁশীর মত শব্দ হয়। দোল আসে। এক অবস্থায় motion and cessation (গতি এবং বিরতি)-এর মত বোধ হয়। স্বামীর অনুভূতি যেন to and from (একেবার সামনে একবার পেছনে হচ্ছে)-এমনতর বোধ করা যায়।  ইলেকট্রিক ব্যাটারি দিলে যেমন শব্দ পাওয়া যায় না, ভিতরে বোধ হয়, রাধাও ঐ রকম সত্তা দিয়ে মানুষ হয়। শেষ দিকে আসে একটা পরম শান্ত অবস্থা।
    আমাদের এই সৎনাম সব মন্ত্রের বীজস্বরূপ। সব বীজের সত্তা হ'লো কম্পন। আর কম্পনের গঠনতন্ত্র অনুভব করা যায় এই নামের মধ্যে। রেডিওর যেমন শর্ট ওয়েভ, মিডিয়াম ওয়েভ এবং নানা মিটার আছে, অনুভূতির রাজ্যেও সেই রকম সব আছে। এগুলি ফালতু কথা না, এগুলির সত্তা আছে। যে সাধন করে সেই বুঝতে পারে। হ্রীং ক্রীং ইত্যাদির স্তরে-স্তরে কত শব্দ এবং তার সঙ্গে-সঙ্গে জ্যোতি ভেসে ওঠে। আর একটা কথা, পরীক্ষা করতে গেলে সদগুরুকে ধরা যায় না। কামনা নিয়ে গেলেও তাঁকে পাওয়া হয় না। কামনা ত্যাগ ক'রে ধরলে তখন তাঁকে পাওয়া যায়। কামনা নিয়ে তাঁতে যুক্ত হ'তে গেলে কামনার সঙ্গে যুক্ত হই, তাঁতে যুক্ত হ'তে পারি না। নিষ্কামের কথা কয়, তার মানে গুরুই আমার একমাত্র কাম্য হবেন, অন্য কোন কামনা থাকবে না। তখনই তাঁকে পাওয়া যাবে।’’
        (আ. প্র. ১৫শ খণ্ড, পৃঃ ২০০-২০১ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্যবাণী)

তাই বাধ্য হয়ে এ-যুগের শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বিকৃতাচারী ধর্মের ধ্বজাধারীদের উদ্দেশ্যে বললেন—
“ভগবান, ইষ্ট বা ধর্ম্মের মৌখিক স্তুতির ভিতর-দিয়ে যা’রা ধর্ম্মবিরোধী কাজ করে, তা’রা হ’ল সব চাইতে বড় শয়তানের দূত–প্রকৃষ্ট লোক-দূষক। ১২৫ । (শাশ্বতী অখণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭)’’
‘‘অনেকে শ্রীকৃষ্ণকে মানে, গীতা মানে, অথচ বর্ণাশ্রম মানে না। গীতার কে কি ব্যাখ্যা করেছেন সেই দোহাই দেয়। কিন্তু গীতার বক্তা শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও বাণী দেখে চতুর্বর্ণ সম্বন্ধে তাঁর মত আমরা কি বুঝি? এ সম্বন্ধে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না, গীতা শ্রীকৃষ্ণের জীবনেই জীবন্তভাবে পরিস্ফুট। গীতায় প্রত্যেক বর্ণের স্বভাবজ কর্ম সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। (আ. প্র. ১৪/১১৮)
কেষ্টঠাকুরের জীবনটা দেখেন, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সবাই তাঁকে পুরুষোত্তমজ্ঞানে পূজা করতেন, কিন্তু তাঁর এত বিয়ের মধ্যে একটাও বামুনের মেয়ে নেই। সমাজ-সংস্থিতির জন্য তিনি বর্ণাশ্রমের বিধান কাঁটায়-কাটায় মেনে গেছেন। (আ. প্র. ৭/৫০)’’
* * *

  যারা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের তো জানা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ, বৃহত্তর রাষ্ট্রকে অধর্মের গ্যাংগ্রীন থেকে বাঁচাতেই সুকৌশলে কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল, শাল্ব কৌরবাদির ন্যায় আততায়ীরূপী গ্যাংগ্রীনদের অপারেশন করেছিলেন।---হিংসাকে হিংসা দ্বারা প্রতিরোধ করে অহিংসার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন! কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সনাতনী আর্য্যকৃষ্টির মূলতত্ত্ব, সদাচার ও বর্ণাশ্রমধর্মভিত্তিক পরমরাষ্ট্রিক সমবায়।
    শ্রীকৃষ্ণের লীলাবসান পরবর্তী শ্রীকৃষ্ণের গীতা-আদর্শের প্রচারক ঋত্বিক সংঘ সক্রিয় থাকার ফলে প্রজাগণ সহজাত-সংস্কার অনুযায়ী সবাই জীবিকা অর্জন করতেন। কেহ কাহারো বৃত্তি-হরণ করতেন না। সকলে আর্য্যকৃষ্টির বিবাহাদি দশবিধ সংস্কার মেনে চলতেন। জনন বিপর্যয় হয় নি, আশ্রমধর্ম ঠিক ছিল। ফলে তিন হাজার বছর পর্যন্ত বৃহত্তর আর্যাবর্তে আগ্রাসন করতে সাহস পায়নি অধার্মিক দুষ্কৃতিরা ! যখন থেকে বর্ণাশ্রম-ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধের শিক্ষা ভুলে, প্রবৃত্তিরূপী শয়তানের প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে আমরা  ক্লীব হয়েছি, তখন থেকে আমরা আগ্রাসনের শিকার হয়েছি। বোধ বিপর্য্যয়ের কারণে, সনাতন ধর্মের অনুশাসন ভুলে, এক আত্মঘাতী উদারতা দেখাতে গিয়ে শক-হুণ-পাঠান-মোগলদের স্বাগত জানিয়েছি। তারা সুযোগ পেয়ে আমাদের জাতীয়তাবোধ, জাতীয়কৃষ্টি অবদলিত করেছে! অনেকদিন পরে, যখন আগ্রাসনের চরম বিপর্যয়, তখন ইংরেজদের অপশাসন থেকে আর্যাবর্তকে মুক্ত করতে আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। সেই শ্রীকৃষ্ণের গীতার আদর্শকে অবলম্বন করে।
    "যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লাণির্ভবতি ভারতঃ।
    অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনম্ সৃজাম্যহম্।।
    পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম্ ।
    ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।।"---বাণীর অনুসরণে।
 গীতার ওই সূত্র অবলম্বনে, চৈতন্যদেব ‘‘যেই রাম সেই কৃষ্ণ, এক দেহে রামকৃষ্ণ’’ রূপে এসে আমাদের ভুল ভাঙিয়ে দিলেন। গীর্জায় গিয়ে যীশুর, মসজিদে গিয়ে রসুলের আরাধনা করলেন। পঞ্চমুণ্ডির আসন সাজিয়ে কোনো তান্ত্রিক-গুরু বসালেন তো বসে পড়লেন। তিনি লোকশিক্ষার জন্য বহু ধর্মীয় মতবাদের  গুরুদের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখেই। তিনি দক্ষিণেশ্বরে পূজারী হয়ে এসেও প্রচলিত পূজা-পদ্ধতি অনুসরণ করেন নি। মৃন্ময়ী জগন্মাতাকে প্রাণবন্ত করে দেখালেন এবং কালী মায়ের আদেশক্রমে নিজে খেয়ে মাকে খাওয়ালেন। ফলহারিনী কালী পূজার শুভলগ্নে সারদাদেবীকে আরাধনা করে চিন্ময়ী মাতৃশক্তিকে আদ্যাশক্তি রূপে শ্রদ্ধা করতে শেখালেন।  ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে শেখালেন,  ভারতবর্ষের শাশ্বত দর্শন, ‘‘বহুজন হিতায় চ, বহুজন সুখায় চ’’-এর আদর্শের উত্তরাধিকারী হয়ে পরমার্থ লাভ করার জন্য তোমাকে আত্ম নিবেদন করতে হবে।
    শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঐশী শক্তিতে শক্তিমান হয়ে নরেন্দ্রনাথ হলেন বিবেকানন্দ। এঁকে দিলেন মহান ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ এক চিত্র। শিকাগো ধর্ম্ম মহাসভার ক্যানভাসে।
    ‘আব্রহ্মস্তম্বভৃদ্ধাতা’–তৃণলতা থেকে ব্রহ্ম, সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির বার্তাবহ বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, সংহিতা, পুরুষোত্তমবাদ নিয়ে বিশ্বজনমানস নতুন করে ভাবতে শুরু করলো।  সনাতন ধর্মের হৃত উত্তরাধিকার ফিরে পেতে ভারতবর্ষ উপনিষদের ‘‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত, প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।।’’ মন্ত্রে আবার নতুন করে জেগে উঠলো।.........
    ‘‘কর্ম্মণ্যেবাধিকারেস্তু মা ফলেষু কদাচন।.......’’ ––কর্মেই তোমার অধিকার ফলে নয়। ––শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ আঁকড়ে নবযুগের অভিমন্যু ক্ষুদিরাম, দেশরক্ষার ধর্ম পালন করতে গিয়ে ফাঁসির আসামী হলেন। ‘‘ন জায়তে ম্রিয়তে কদাচিৎ.......বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়.........নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।.......’’। বাণীর অমৃত আদর্শে স্থিতপ্রজ্ঞ, মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম হাসিমুখে ফাঁসির দড়ির মালা পড়লেন গলায়। একটা ক্ষুদিরামের আত্মাহুতি জন্ম দিল হাজারো ক্ষুদিরামের। ফাঁসিরজ্জু আর ইংরেজ রাজশক্তির বুলেটের আলিঙ্গনে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে অকালে হাসিমুখে বিদায় নিল উত্তরাধিকারের স্বপ্নদেখা কতশত বীর ভারত-সন্তানেরা।

স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম ‘গীতা’-বর্ণিত ‘‘হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং/জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্’’-এর বাণীর অনুসরণে অমরত্ব লাভের অনুশাসন মেনে মৃত্যু বরণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মৃত্যুঞ্জয়ী হতে শিখিয়েছিলেন। গীতা গ্রন্থের সেইসব বীরগাঁথা ভুলে আমরা তাঁর ঋণ শোধ করছি, ‘কৃষ্ণ করলেই লীলা, আমরা করলেই বীলা’ গানের ডালি সাজিয়ে! যদিও ওই গান রচনা করার সাহস আমরাই দিয়েছি,—যারা ধর্মের ধ্বজা ধরে প্রবৃত্তিকে পোষণ দিয়ে চলেছি।–-পার্থসারথী শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভাগবতগীতার আদর্শ ভুলে, হ্লাদিনি শক্তিরূপিনী রাধা-তত্ত্ব ভুলে, মনগড়া প্রবৃত্তি-প্ররোচিত মানবী রাধা, শ্রীকৃষ্ণের মামীর সাথে পরকীয়া কামুক-রূপে, গোপিনীদের বস্ত্রহরণকারী-রূপে শ্রীকৃষ্ণকে চিত্রিত করে!
‘রাই জাগো রাই জাগো বলে শুক-সারি বলে, কত নিদ্রা যাওগো রাধে শ্যাম-নাগরের কোলে।…..’ এবং ‘রাই জাগোরে, জাগো শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই/শ্যাম অঙ্গে অঙ্গ দিয়া আছোরে রাই ঘুমাইয়া তোমার কি লোকলজ্জা নাই….’ ওই প্রভাতী গান দুটো বৈষ্ণব মহলে শুধু নয়, কীর্তন হিসেবেও সমাদৃত, জনপ্রিয়। গান দুটোর ভাষা বিশ্লেষণ করে একবার দেখুন।
শাস্ত্র অনুযায়ী আর্য্য হিন্দুদের ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে ঈশ্বরোপাসনা করতে হয়। আর প্রাকৃতিক নিয়মে ব্রাহ্মমুহূর্ত কালে সব পাখিরা জেগে যায়। স্বভাবতই শুক-সারি পাখি জেগে গিয়েছে। রাধা তখনো নাগর কৃষ্ণের অঙ্কশায়িনী হয়ে শুয়ে আছে। নগরবাসীরা যদি জানতে পারে তাহলে লজ্জায় পড়তে হবে। তাই শুক-সারী পাখি ওদের ভাষার জাগরণী গান গেয়ে রাধাকে সাবধান করে দিচ্ছেন। আর কৃষ্ণ ভক্তেরা ভালোমন্দ বিচার না করে, ওই গানকেই জাগরণীর জন্য আদর্শ গান হিসেবে নির্বাচন করে গেয়ে চলেছেন। এবার বিচার করে দেখুন, কাম-রসাত্মক চটুল কথায় প্রভাতী সুর লাগিয়ে শ্রীকৃষ্ণের নামে ওই আরাধনা আর্য্যকৃষ্টি বিরোধী প্রবৃত্তি-প্ররোচিত পরদারাসক্ত ব্যতীত কোন্ আধ্যাত্মিক আবেদনে সমৃদ্ধ ? ওইসব জাগরণী গান শুনে, এবং কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দের ছত্রে ছত্রে বর্ণিত কামবিলাসী, ‘দেহি পদপল্লব মুদারম্’ বলে রাধার মানভঞ্জন করা, পরকীয়া নিয়ে ব্যস্ত শ্রীকৃষ্ণের কীর্তিকলাপ পড়ে, যদি কোন তথাকথিত নাস্তিক্যবাদী শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রে কালিমালিপ্ত করে, —সেই ধর্মবিরোধী, ইষ্টবিরোধী প্রচারের জন্য দায়ী কারা?
শ্রীকৃষ্ণ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, ‘‘ …….. ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম অর্থাৎ বৃদ্ধির ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রাণপাত করলেন। অথচ ব্রাহ্মণকুলতিলক দ্রোণাচার্য্যই তাঁর বিরুদ্ধে গেলেন। ভীষ্ম অন্নের কৃতজ্ঞতার দোহাই দিয়ে কৌরবপক্ষে গেলেন। কিন্তু যে-অন্ন তিনি খেয়েছিলেন সে-অন্নের অর্দ্ধেক মালিক পাণ্ডবরা। যা হোক, ধর্ম্ম কোথায়, ন্যায় কোথায়, লোকহিত কোথায়, কৌরবপক্ষ তা না বোঝার ফলে যুদ্ধ অনিবার্য্য হয়ে উঠলো। এতসব বিপর্য্যয় সত্ত্বেও কেষ্টঠাকুর ঘরে-ঘরে ঋত্বিক, অধ্বর্য্যু, যাজক পাঠিয়ে লোকের মনন ও চলনের ধারা দিলেন বদলে। করলেন ধর্ম্মের সংস্থাপনা। বুদ্ধদেব আসবার পর বৌদ্ধভিক্ষুরা দেশ ছেয়ে ফেললো, যার পরিণাম অশোক। অশোকের ভুলত্রুটি যাই থাক, শোনা যায়, অমনতর সম্রাট ও অমনতর সাম্রাজ্য নাকি কমই হয়েছে। রসুল আসার পর ইসলামের যাজনের ঢেউ কী রকম উঠেছিল তা কারও অজানা নয়। বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলমান সবাই তাদের যাজনের রেশটা কম-বেশী ধরে রেখেছে। প্রচারক আছে, প্রচেষ্টা আছে। অবশ্য, আচরণহীন প্রচারণায় যতটুকু হতে পারে ততটুকুই হচ্ছে। তবু মানুষের কানের ভিতর কথাগুলি ঢুকছে। কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে হানা দেবার কেউ নেই। তারা কেউ জুটলো না। অথচ হুজুগ করার এত লোক জুটছে। হুজুগ করে দল বেঁধে জেলে গেলে তাতে মানুষ কতখানি গড়ে উঠবে তা বুঝতে পারি না। (আ. প্র. ৮ম খণ্ড, ২৬. ০৬. ১৯৪৬)
“আলেকজাণ্ডারের আগে পর্য্যন্ত কোন আক্রমণকারী আমাদের দেশে ঢুঁ মেরে কিছু করতে পারেনি । অশোকের Buddhism (বৌদ্ধবাদ)-এর পর থেকে বর্ণাশ্রম ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই থেকেই সমাজ ও জাতি দুর্ব্বল হয়ে পড়ে । বুদ্ধদেব গৃহীর জন্য বর্ণাশ্রম রক্ষা করতে বলেছেন । আর ভিক্ষু, শ্রমণ ইত্যাদির বেলায় ওটার ওপর জোর দেননি । আর, সে ক্ষেত্রে ওর প্রয়োজনও ছিল না । কারণ, ভিক্ষু বা শ্রমণদের কোন যৌন সংশ্রব ছিল না । কিন্তু ভিক্ষুণীপ্রথা প্রবর্তনে সে বাঁধনও ভেঙে গেল । বুদ্ধদেব যে স্বর্ণযুগ আনতে চেয়েছিলেন তা আর সম্ভব হ’ল না ।”
(আ. প্র. ২১/৬. ৮. ১৯৫২)

  • * * আর একবার কৃষ্ণকথায় ফিরে আসছি। বিচার করে দেখব, কৃষ্ণ-রাধার আজগুবী তত্ত্বের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি-না। পণ্ডিতদের মতে কংসের দূত হয়ে মহামতি অক্রুর, বলরামসহ শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে মথুরায় নিয়ে যান কংস আয়োজিত ধনুর্যজ্ঞে অংশগ্রহণ করাতে। কংসের উদ্দেশ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার। পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণ অত্যাচারী কংস-মামাকে হত্যা করে পিতামহ উগ্রসেনকে রাজ্য প্রত্যর্পণ করেন। তারপর ঘোর আঙ্গিরসের সান্নিধ্যে পরাবিদ্যা এবং সান্দিপনী কাশ্যের সান্নিধ্যে অপরাবিদ্যা লাভ করেন আর বৃন্দাবনে ফিরে যান নি।
    পণ্ডিতদের এই সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত, শ্রীকৃষ্ণ ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে কংসকে বধ করেন। অথচ বেশীরভাগ কৃষ্ণভক্তগণ বৃন্দাবন লীলার, রাসলীলার নামে যে যুবক কৃষ্ণকে মানবী রাধার সাথে যুগলবন্দী করে পরকীয়া কামুক রূপে চিত্রিত করে চলেছেন, সে কৃষ্ণ কোন কৃষ্ণ? সে কি বৃষ্ণিসিংহ দেবকীনন্দন, না অন্য কেউ ? সে কি গীতার প্রবক্তা পার্থসারথী, না অন্য কেউ? কারণ, বৈষ্ণবদের প্রামাণ্য গ্রন্থ ভাগবতে রাধা-কৃষ্ণের ওইসব অবৈধ পরকীয়া-লীলার কোন কাহিনী লিপিবদ্ধ নেই। অথচ কৃষ্ণের প্রচারকেরা গীতার কথা বলেন, ভাগবতের কথা বলেন, অথচ আয়ান ঘোষের ঘরণী রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের সাথে এক অবৈধ সম্পর্কের সাথে জুড়ে নিয়ে কৃষ্ণনাম করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের যে বদনাম করে চলেছেন, সেটাও তাদের বোধে ধরা পড়ে না, এমনই ধার্মিক তা’রা !
    কৃষ্ণকে একমাত্র ভগবান বলে মানেন যারা, তারা আবার শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধারও উপাসনা করেন, কোন্ যুক্তিতে? তাদের অনেকেই আবার শ্রীকৃষ্ণের নব-কলেবর জ্ঞানে চৈতন্যদেবের প্রতিকৃতির উপাসনাও করেন। তা’রা বলেন, চৈতন্যদেব রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার। খুব ভাল কথা। তাই যদি হয়, তাহলে তো একঅঙ্গে দুই-রূপ যুগল অবতার-স্বরূপ চৈতন্যদেবেরই আরাধনা করতে হয়। আলাদা করে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তির আরাধনার প্রয়োজন নেই। কারণ গীতার বাণী ‘‘তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তি র্বিশিষ্যতে।’’ (৭ম অধ্যায়) অনুসারে পুরুষোত্তম ব্যতীত একাধিক আদর্শকে মনে স্থান দিলেও ব্যভিচার করা হয়, যা ইষ্টলাভের বা ঈশ্বরলাভের পথে অন্তরায়। ইসকন ভক্তদের এ বিষয়টা একবার ভেবে দেখা উচিত। কারণ, আমরা জীবনপিয়াসী যারা, তারা যদি এভাবে জীবনদেবতার অপমান করে চলি, আমাদের জীবন কিভাবে সমৃদ্ধ হবে? —————————————-
    নিবেদনে— তপন দাস@tapandasd