অভিজিৎ বসু: গ্রামের লোকরা বলে এই মেলা নাকি এক মাত্র তেনাদেরই মেলা। এই তেনাদের নাম নাকি আবার যখন তখন করতে নেই কাউকে। সন্ধ্যায় আর রাতে তো একদমই নয়। তাহলে তেনারা খুবই রুষ্ট হন। আর তাঁরা যদি রেগে যান তাহলে আর রক্ষে নেই কিন্তু কোনও মতেই কারুর। আর তাই তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতেই এই বিশেষ মেলার আয়োজন। একদম ব্রহ্মদৈত্যর মেলা বলে কথা। সত্যিই এমন মেলার কথা সচরাচর শোনা যায়না কিন্তু।
সেই তাঁকে সন্তুষ্ট করে এলাকায় শান্তি আর স্বস্তি স্থাপনের জন্য এই মেলা আর তাঁর পূজো খুব দরকার। তিনি রেগে গেলেই কিন্তু মহাবিপদ ঘটবে এলাকায়। আর তাই তেনাকে সন্তুষ্ট করতে বীরভূমের ময়ূরেশ্বর থানার ঢেকা পঞ্চায়েতের ঢেকা গ্রামের এই বিরাট মাঝ মাঠে দীর্ঘ দিন ধরেই হয়ে আসছে পুরাকালের এই ব্রহ্মদৈত্যের পূজা হয়। মাঘ মাসের প্রথম দিনে হয় এই পূজা।
আর এই পূজা উপলক্ষে মেলা বসে প্রতিবছর মাঘ মাসের পয়লা তারিখে ঢেকা গ্রামের মাঝ মাঠে। এই ব্রহ্মদৈত্যের মেলা নিয়ে বেশ জমজমাট ঢেকা গ্রাম।আশপাশের প্রায় পনেরো বিশটি গ্রামের মানুষ ভীড় করেন এই মেলা দেখতে। মাঠের চারিধারে বসে যায় নানা পসরা। বেতের বোনা ধামা কুলো থেকে শুরু করে কাঠের চেয়ার, আলমারি, আলনা, চৌকি বিক্রি হয় এই ভূতের মেলায়। তার সাথে আছে নানা রকমারি ঘর গৃহস্থালির জিনিস। যা দিয়ে সংসার এর কাজে লাগে। আর তাই সংক্রান্তির পরদিন এই ব্রহ্মদৈত্য মেলা দেখতে ভীড় জমে যায় ময়ুরেশ্বর এর ঢেকা গ্রামে।
গল্পে আছে বহু বছর আগে এই ঢেকা গ্রামের মাঝে মাঠে একটি বিরাট বট গাছ ছিল। সেই বট গাছে বাবা ব্রহ্মদৈত্যে বাস করতেন। দিনের বেলায় গ্রামের লোকজন সেই মাঠে কেউ কেউ প্রবেশ করলেও সন্ধ্যার পর কেউ যেতে পারত না সেই মাঠের ধারে। অনেকের অনেক রকমের খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। আর তাই বাবাকে তুষ্ট রাখতেই সংক্রান্তির পরদিন এই পূজোর আয়োজন। যে পূজো ঘিরে মানুষের ভীড় উপচে পড়ে।
এই গ্রামের বাসিন্দা তপন মন্ডলের কথায় আমরা গ্রামের ঐতিহ্যকে মেনে আজও এই মেলা করে আসছি। মেলার পরিসর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু মানুষের ভীড় বেড়েছে এই মেলায়। অন্যদিকে এই মেলায় যিনি বংশ পরম্পরায় পূজো করে আসছেন সেই পুরোহিত দেবীপ্রসাদ মিশ্র জানালেন যে, বর্গীর আমল থেকেই এই মেলা হয়ে আসছে। তাঁর মনে আছে প্রায় তাদের পাঁচ পুরুষ এই মেলায় পূজো করে আসছেন। পাঁচশো বছর বা সাতশো বছরের এই মেলা। করোনার সময় বাদ দিলে এই মেলা প্রতিবছর হয়। যে মেলাকে আবার কেউ কেউ ভূত মেলাও বলে থাকেন।
সত্যিই গ্রামেগঞ্জে এমন কত যে মেলা ছড়িয়ে আছে তার শেষ নেই। নানা ধরনের মেলা, তার গল্পগাথা তার নানা অজানা কাহিনী লুকিয়ে আছে। তবে এই ভূত মেলা বা ব্রহ্মদৈত্য মেলা কিন্তু সত্যি সত্যিই অসাধারণ একটি মেলা। মাছ মেলার পর এই ভূত মেলা বা ব্রহ্ম দৈত্যের মেলার কথা লিখতে বসে মনে পড়ে যায় সন্ধ্যা হলেই নাকি তেনারা খুব ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক। ঢেকা গ্রামের মাঝমাঠে আজও সেই গাছের নিচে পয়লা মাঘ এই ব্রহ্মদৈত্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই মেলায় ভীড় করেন হাজার হাজার মানুষ।
বীরভূমের ঢেকা গ্রামে জমজমাট ‘তেনাদের মেলা’
